রক্ষণে থেকে আক্রমণ, তিনি আছেন সর্বত্র

ঝাঁকড়া চুলের একটা ছেলে। দৌড়ে যাচ্ছে মাঠের বাম পাশ দিয়ে। বা-পাটা তাঁর বেশ ভাল। দুই তিনজন খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে তিনি ছুটলেন অদম্য গতিতে। তারপর ডি-বক্সের বাইরে থেকে ক্রস করলেন। একেবারে নিখুঁত এক ক্রস। ব্যাস, তাতে মাথা ছুঁয়ে গোল আদায় করে নিলেন তাঁরই সতীর্থ।

এমন দৃশ্য গত একটা দশক ধরে যেন রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা ব্রাজিল ফুটবল সমর্থকদের সবচেয়ে পছন্দের এক দৃশ্য ছিল। আর সে দৃশ্যের মঞ্চায়ন করতেন মার্সেলো ভিয়েরা দ্য সিলভা জুনিয়র। মার্সেলো নামেই যিনি অধিক পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এক ক্লাবে খেলা মার্সেলোর শুরুটা একেবারে সাজানো-গোছানো ছিল না।

মার্সেলোর জন্ম ১৯৮৮ সালের ১২ মে, ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওর নিকটবর্তী এক এলাকায়। সে সময়ের আর পাঁচটা পরিবারের মতই দ্রারিদ্র গ্রাস করেছিল মার্সেলোর পরিবারকে। বাবা ছিলেন ফায়ার বিগ্রেডের সদস্য, মা ছিলেন সাবেক শিক্ষিকা। খুব একটা স্বচ্ছলতার মধ্য দিয়ে মার্সেলো তাঁর বাল্যকাল পার করেছে তেমনটা বলার সুযোগ নেই।

এমনকি খুব ছোট বয়সেই অর্থাভাবে মার্সেলোকে চিন্তা করতে হয়েছিল আয়ের কথা। তবে মার্সেলোর প্রথম প্রেম ছিল ফুটবল। ব্রাজিলের প্রতিটি খেলোয়াড়ের উত্থানের নেপথ্যে ব্রাজিলের রাস্তা, ব্রাজিলের যেকোন কোনায় থাকা একটু খালি জায়গা ব্যাপক ভুমিকা রেখেছে। মার্সেলোর ক্ষেত্রেও একই। তিনি রাস্তায়, সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলেই হয়েছেন ফুটবলের আকাশে একজন তারকা।

আর সে সমুদ্রতটেই প্রথম তিনি দেখেছিলেন তাঁর সহধর্মিণীকে। সেখান থেকেই প্রণয়ের শুরু এবং শেষমেশ বিয়ে সংসার। এই বিচ ফুটবল দু’হাত ভরে আশির্বাদ হয়ে হাজির হয়েছিলে মার্সেলোর জীবনে। মাত্র নয় বছর বয়সেই ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমেন্সের ছায়াতলে এসে যান মার্সেলো। তবে সেখানে থাকার পথটাও খুব একটা মসৃণ ছিলনা তাঁর। ক্লাবটিতে গিয়ে অনুশীলন করার জন্য প্রয়োজন ছিল যাতায়াত ব্যবস্থার।

সেটুকুর জোগানও দিতে হিমশিম খেয়ে যেতেন মার্সেলো। বাস ভাড়া জোগান দেওয়াটা এক প্রকার বোঝায় পরিণত হয়েছিল তাঁর জন্যে। তাঁর সে বোঝা খানিক হালকা করে দিতেন তাঁর দাদু স্যান পেদ্রো। তিনিই নাতির খেলাটার আর্থিক জোগান দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে মাঝেসাঝে তিনিও সংকটে ভুগেছেন। তবে মার্সেলোর ভাগ্য যেন তাঁর প্রতি ছিল দারুণভাবে সহায়।

মার্সেলো তাঁর দাদুর সাথে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছিলেন। একবার তাঁর দাদুর কাছে শুধু মাত্র একটি ব্রাজিলিয়ান রিয়াল ছিল। অথচ মার্সেলোর প্রতিদিনের অনুশীলনের জন্যে ১৩ রিয়াল করে পরিশোধ করতে হত। তাই পেদ্রো বাঁধ্য হয়ে রাস্তার পাশে থাকা একধরণের গেমিং মেশিনে সেই এক রিয়ালের বিনিময়ে রীতিমত বাজি ধরে। ভাগ্যের খেল। সে রিয়ালের পরিবর্তে ২৫ রিয়াল পেয়েছিল মার্সেলোরা। এভাবেই মার্সেলোর ভাগ্যও তাঁর সাথে ছিল তাঁর সফলতার জার্নিতে।

ফ্লুমিনেন্স ক্লাবের কর্তারাও মাঝে তাঁর দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। নেবেন না কেন বলুন। এমন প্রতিভাবান একজন খেলোয়াড়কে তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। আর ব্রাজিলের সবাই যখন ফুটবলে উন্মাদ তখন নিশ্চয়ই মার্সেলোর মাঝে কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর ক্লাব কর্তারা তাইতো তাঁর দায়িত্ব নিতে দ্বিধা করেননি। মার্সেলো যে ছিলে এক অনন্য হিরা তা আর বুঝতে বাকি থাকে না।

২০০৭ সাল নাগাদ মার্সেলোকে দলে ভেড়াতে উঠে পড়ে লাগে ইউরোপের সব বড় বড় ক্লাব। তবে মার্সেলোর শেষ ঠাঁই হয় স্প্যানিশ পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদে। আর সেখানেই তিনি কাটিয়ে দিলেন নিজের ক্যারিয়ারের স্বর্নালী দিন। এ সময়ে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন ভুড়িভুড়ি। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন পাওলো মালদিনি, ডিয়েগো ম্যারাডোনার মত খেলোয়াড়ও।

এটাও বলা হত যে মার্সেলো নাকি কিংবদন্তি রবার্তো কার্লোসের উত্তরসূরী। ভক্ত-সমর্থকরা তো বলতই এমনকি খোদ কার্লোস তাঁর খেলায় মুগ্ধ হয়ে একদফা বলেছিলেন যে মার্সেলোই তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। হ্যাঁ, ঠিক এতটা কার্য্যকর ছিলেন মার্সেলো তাঁর ক্যারিয়ারের ‘প্রাইম টাইমে’। রিয়ালের পরিকল্পনার একটা বিশাল অংশ জুড়ে ছিলেন মার্সেলো। অর্জনে ঠাসা ক্লাবটার অধিনায়কের দায়িত্ব পালনও করেছেন তিনি।

২০২১-২২ মৌসুমটাই হয়ত তাঁর রিয়াল ক্যারিয়ারে শেষ। আর দেখা যাবে না সাদা জার্সি গায়ে, ঝাঁকড়া চুলের দৌড় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। আর দেখা যাবে না গোলের সব ভিন্নধর্মী উদযাপন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link