হিউ ট্রাম্বল এবং ১৯০২ অ্যাশেজ

ট্রাম্বল করতেন জোরের ওপর অফস্পিন। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলেন ট্রাম্বল নাকি কংক্রিটেও বল ঘোড়াতে পারতেন। তৎকালীন আ-ঢাকা ভেজা পিচে তাহলে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন সেটা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

১৮৯০ সালে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের স্থাপনা এবং ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা – এই সময়কালকে যদি ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ হিসেবে ধরা যায়, তবে ১৯০২ এর অ্যাশেজ সেই স্বর্ণযুগের ঠিক মধ্যগগনে অনুষ্ঠিত হয়। সর্বকালের সেরা টেস্ট সিরিজ নিয়ে আমরা যখন আলোচনা করি, তখন ২০০৫ সালের অ্যাশেজ, ২০০১ সালের বোর্ডার-গাভাস্কার বা ১৯৬০-এর অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আরো অনেক সিরিজ আলোচনায় আসে।

অথচ ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই ১৯০২ এর অ্যাশেজ নিয়ে আলোচনা হয় খুবই সামান্য। তৎকালীন বহু পন্ডিতের মতে, ১৯০২-এর অ্যাশেজে যে দল ইংল্যান্ডের ছিল, তা তাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। ব্যাটিংয়ে ছিলেন অধিনায়ক অর্চি ম্যাকলারেন, রঞ্জি এবং ধুঁয়াধার গিলবার্ট জেসপ। বোলিংয়ে উইলফ্রেড রোড্স্, জন টিলডেলসলেই, লেন ব্রাউন্ড, জর্জ হার্স্ট।

এজবাস্টনে খেলা প্রথম টেস্টে তো ইংল্যান্ডের একাদশের প্রত্যেকের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সেঞ্চুরি ছিল। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া ও কম যায় না। ব্যাটিংয়ে ট্রাম্পার, রেজি ডাফ, ক্লেম হিল, অধিনায়ক জো ডার্লিং এবং বিশাল বপু ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং। বোলিংয়ে ট্রাম্বল এবং নোবেল। এই দুই বোলারের জুটি বছরের শুরুতে মেলবোর্ন টেস্টে একাই ২০ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে শুইয়ে দিয়েছে।

বছরের শুরুতে হয়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ যুদ্ধে ইংল্যান্ড কার্যত উড়ে গেছে ৪-১ ফলে। স্বভাবতই ব্রিটিশ জাত্যাভিমান রক্তের খোঁজে ব্যাকুল। সেই সময় ইংল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ হতো তিন দিনের। প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া কে বাগে পেয়েও বৃষ্টির কারণে ইংল্যান্ড জিততে পারেনি। ট্রাম্পার সম্বলিত ব্যাটিং অর্ডার ও উড়ে গেছিলো ৩৬ রানে। দ্বিতীয় টেস্টে লর্ডস এও মাত্র ৩৮ ওভার খেলা হয়। বাকি দুই দিন বৃষ্টিস্নাত হয়ে শেষ হয়ে যায়।

প্রথম দুই টেস্টে খেলেননি হিউ ট্রাম্বল। শেফিল্ডের ব্রাম্যাল লেনে খেলা একমাত্র টেস্টে (ব্রাম্যাল লেন এখন সম্পূর্ণরূপে ফুটবল মাঠ) অস্ট্রেলিয়া বেশ বড়ো ব্যবধানে হারায় ইংল্যান্ডকে। ট্রাম্বল এবং নোবেল মিলে নেন ইংল্যান্ডের ১৫ উইকেট। গিলবার্ট জেসপ, যিনি এই সিরিজে ব্যাটিং লোকগাথা তৈরি করবেন, করলেন ৫৫। ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজ জিততে হলে জিততেই হবে শেষ দুই টেস্ট।

চতুর্থ টেস্ট হবে ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ট্রাম্পার, ডাফ এবং হিলের দাপটে অস্ট্রেলিয়া তোলে ২৯৯। জবাবে স্ট্যানলি জ্যাকসনের সেঞ্চুরি তে চেপে ইংল্যান্ড তোলে ২৬২। ট্রাম্বল আবার ৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ভিজে পিচে অস্ট্রেলিয়া অপ্রত্যাশিত ৮৬ অল-আউট হয়ে ইংল্যান্ডের সামনে বড়ো সুযোগ নিয়ে আসে। বিল লোকউড প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেটের পর, দ্বিতীয়তেও ৫ উইকেট নিয়ে ভাঙলেন অস্ট্রেলিয়াকে।

অধিনায়ক ডার্লিং ৩৭ না করলে অস্ট্রেলিয়ার কি হাল হতো বলা যায় না। ১২৪ তাড়া করতে নেমে এক অধিনায়ক ম্যাকলারেন ছাড়া কেউই ট্রাম্বল, সন্ডার্স জুটির কাছে দাঁড়াতে পারলেন না। ট্রাম্বল অপরিবর্তিত থেকে ৬ উইকেট নিলেন। ট্রাম্বল করতেন জোরের ওপর অফস্পিন। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলেন ট্রাম্বল নাকি কংক্রিটেও বল ঘোড়াতে পারতেন।

তৎকালীন আ-ঢাকা ভেজা পিচে তাহলে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন সেটা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। ততদিনে অ্যাশেজ হেরে গিয়ে অভিমান ছাড়া ওভাল টেস্টে আর কিছুই পাওয়ার ছিল না ইংল্যান্ডের। অথচ তাও সেই ওভাল টেস্ট, আজও অ্যাশেজ এবং ক্রিকেটের ইতিহাসে অমর হয়ে রয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া প্রথমে ব্যাট করে ৩২৪ করে। ট্রাম্পার এবং নোবেল ছাড়া, উপরিভাগ ও মধ্যভাগের ব্যাটসম্যানরা কেউ দাঁড়াতেই পারেননি।

১৭৫ রানে ৭ উইকেট, এই অবস্থায় ক্রিজে এলেন ট্রাম্বল। তিনি ৬৪ রানের ওই অমূল্য ইনিংসটি না খেললে, লোকউড এবং হার্স্টের দাপটে অস্ট্রেলিয়া অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে বল হাতেও নায়ক ট্রাম্বল। ফের এক প্রান্তে অপরিবর্তিত থেকে বোলিং করে ৬৫ রানে ৮ উইকেট তুলে নেন তিনি। ইংল্যান্ড পিছিয়ে পরে ১৪১ রানে।

দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য ক্রমশ ভাঙতে থাকা পিচে অস্ট্রেলিয়া শেষ হয়ে যায় ১২১ রানে। তাতেও অবশ্য তারাই ছিল চালকের আসনে। কারণ আঢাকা পিচে, ট্রাম্বল, সন্ডার্স, নোবেল দের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ২৬৩ করবে, এটা কষ্টকল্পনা। শুরুটাও হলো প্রত্যাশিত। ৪৮ রানে ৫ উইকেট, এই অবস্থায় ক্রিসে এলেন গিলবার্ট জেসপ। সিরিজে তখনো পর্যন্ত মাত্র ৮৬ রান করেছেন তিনি। কিন্তু এরপর যা করবেন তিনি সেটার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।

শুধু বলে রাখি, ১৭ টি ৪ মেরে ৭৭ মিনিটে ১০৪ রান করেন জেসপ। কয়েকটি চার আজকের নিয়মে ছয় হতো। তিনি যখন আউট হলেন স্কোর তখন ১৮৭ রানে ৭ উইকেট। ক্রিজে তিনি থাকাকালীন ১৩৯ রান ওঠে যার মধ্যে তিনি একই ১০৪ করেন। এরপরও অস্ট্রেলিয়ার এই টেস্ট যেটা পাওয়া উচিৎ, তা পায়নি। কিন্তু জর্জ হার্স্ট এবং ভবিষ্যতে ইংল্যান্ডের হয়ে ওপেন করা (কিন্তু এই টেস্টে ১১ নম্বর) উইলফ্রেড রোডস ইংল্যান্ডকে জিতিয়ে দেন এক উইকেটে।

ট্রাম্বল এই ইনিংসেও অপরিবর্তিত থেকে ৩৩.৫ ওভার করেন এবং ৪ উইকেট তোলেন। পরপর তিন ইনিংসে অপরিবর্তিত থেকে টানা বল করে যাবার রেকর্ড আর কারো আছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু থাকলে আশ্চর্য্য হবো। ট্রাম্বল যে তিনটি টেস্ট খেলেন, তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার করা সব বলের ৪১.১৭% তিনি করেছিলেন। তিনটি বা তার অধিক টেস্ট সিরিজে এটা রেকর্ড।

মাত্র তিন টেস্ট খেলে ২৬ উইকেট নেন সেই সিরিজে ট্রাম্বল। ওভাল টেস্ট কে এখন জেসোপের টেস্ট বলা হয় এবং সঙ্গত কারণেই। কিন্তু কেউ যদি জেসপ এবং ট্রাম্বলের যুগ্ম টেস্ট ও বলে, আশা করি কারোর কিছু বলার থাকবে না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...