ইউরোপের বড় ক্লাব গুলোকে খুব সহজেই ব্যাংকের সাথে তুলনা করা যায়। অর্থ ব্যয়ের দিক দিয়ে তাঁরা হয়তো ব্যাংকের চেয়ে কম দায়িত্বশীল কিন্তু ‘টু বিগ টু ফল’ এই টার্মটি তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
অর্থনীতির দুনিয়ায় একটি কথা চালু আছে যত খারাপ ভাবেই পরিচালনা করা হোক না কেন কিছু ব্যাঙ্ক রয়েছে যাদেরকে কখনোই দেউলিয়া হতে দেওয়া যাবে না। বিশ্বমন্দা চলাকালীন সময় অনেক্ দেশের সরকার নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক যেগুলো দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল তাদেরকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করে যাতে সেই ব্যাংক গুলো নিজস্ব কার্যক্রম স্বাভাবিক ভাবে বজায় রাখতে পারে।
সরকারের এই ধরনের সিধান্তের পেছেনের কারণ খুব সহজেই বোঝা যায়, যদিও ব্যাঙ্কগুলো নিজস্ব অব্যবস্থাপনার কারণে এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। কিন্তু, ব্যাংক দেউলিয়া হলে সাধারণ জনগনের সমস্যা হবে এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিবে।
‘টু বিগ টু ফল’ এই অবলম্বন করলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমেরিকার সাবেক ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ার বেন শ্যালম বার্নানকে এই সম্পর্কে বলেন যে ‘টু বিগ টু ফল’ এই নীতি অবলম্বনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারনত যতটা কাম্য তারচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয় এই আশায় যে তাঁরা বাজিমাত করতে না পারলেও তাদেরকে উঠে দাড়াতে আবার সাহায্য করা হবে।
ফুটবল দুনিয়ায় বার্নানকের এই উক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল বার্সেলোনা। ইউরোপিয়ান এই ক্লাব বিস্ময়করভাব মনে করে তাদের দুর্দিনে অন্যদের সাহায্য পাওয়া তাঁদের প্রাপ্য।
- বার্তোমেউ আমলে অর্থের নিদারুণ অপচয়
জোসেফ মারিয়া বার্তোমেউ তার আমলে এই ‘টু বিগ টু ফল’ নীতি প্রয়োগ করেন যা ক্লাবটির বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশার অন্যতম কারণ।
তিনি অবিরাম বেপরোয়া সিধান্ত নিতে থাকেন যার ফলাফল ২০১৪-২০১৯ অবধি তিনি প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ইউরো দলবদলের বাজারে খরচ করেন যার পুরোটাই নষ্ট হয়েছে বলা যায়। এই সময় তিনি মাত্র দুইজন ভাল খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে সক্ষম হন।
লা লিগা বার বার ক্লাব গুলোকে তাঁদের অর্জিত আয়ের ৭০ ভাগের বেশি খেলোওয়াড়দের বেতনে খরচ করতে মানা করলেও তাকে বুড় আঙ্গুল দেখিয়ে বার্তোমেউ একের পর এক উচ্চ বেতনের খেলোওয়াড় দলভুক্ত করেছেন।
এ সম্পর্কে বার্তোমেউ দাবি করেন যে উয়েফা এবং লা লালিগা খেলোওয়াড়দের বেতন সম্পর্কে অনেক পরামর্শ দিলেও আদতে তাদের আনুষ্ঠানিক কোন বেতনের সীমা দেওয়া নেই। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে তাঁরা হয়তো আদর্শ মাপকাঠির থেকে বেশি খরচ করছেন কিন্তু তা দেওয়ার সামর্থ্য তাদের আছে।
আর এটা নাকি তাদের পরিকল্পনার অংশ যা অত্যন্ত টেকসই । ২০২০’র বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ক্লাবটির অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং তাঁদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দুর্বলতাগুলো তীব্রভাবে ফুটে উঠে। বার্তোমেউ বার্সেলোনাকে ব্যতিক্রমী ফুটবল ক্লাব মনে করতেন, যা সত্যি তবে ভুল সব কারণে তারা ক্রীড়া দুনিয়ায় এই তকমা পেয়েছে।
কাতালুনিয়ার এই ক্লাবটি অন্য সকলের চেয়ে ব্যতিক্রমী, অন্য ক্লাবগুলো যেই নিয়মে পরিচালনা করা হয় তারা সেই নিয়ম মানতে নারাজ না হলে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ইউরো দেনা থাকা সত্তেও রবার্ট লেওয়ানডস্কি, রাফিনহা, কেসি এবং ক্রিস্টেনসেনকে দলে ভেড়াতে পারতো না। নতুন খেলোওয়াড় কাওকেই ২০২২-২৩ মৌসুমের জন্য এখনো নিবন্ধিত করতে পারেনী বার্সেলোনা।
- গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে লাপোর্তার খরচের হিড়িক
জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ আর বার্সেলোনায় না থাকলেও হুয়ান লাপর্তা তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টের পর থেকে পুরোপুরি সরে আসেননি। বার্সেলোনার দল বদল সম্পর্কে বায়ার্ন মিউনিখ ম্যানেজার জুলিয়ান নাগেলসম্যান বলেন তারা অনেক নতুন খেলোওয়াড় দলে ভেড়াচ্ছে, তারা এটা কিভাবে করছে সে ব্যাপারে তার কোন ধারণা নেই। তিনি বলেন বার্সেলোনাই একমাত্র ক্লাব যারা কোন টাকা না থাকা সত্ত্বেও দলে খেলোওয়াড় ভেড়াতে পারে। তার কাছে একে উদ্ভট পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
বার্সেলোনা ফুটবলীয় অভিধানে ‘লেভার’ এর প্রবর্তন করেছে। লাপোর্তা এই ‘লেভার’ প্রন্থা দিয়েই বার্সার অর্থনৈতিক দুর্দশা দূর করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ক্লাবের হাল ধরার পর লাপোর্তা কিছু বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। খেলোওয়ারদের বেতন কমিয়েছেন যার প্রয়জন ছিল খুবই কিন্তু তারপরও তার কর্মকাণ্ডে ‘টু বিগ টু ফল’ নীতির ছাপ বিদ্যমান।
বিচক্ষণতার সাথে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ক্লাবটির দুরবস্থা কাটানোর বদলে ২০২২-২০২৩ মৌসুমকে লক্ষ করে প্রাণপণে সব সম্পদ খরচ করছে বার্সা। এই মৌসুমে যদি তাঁরা আশানরুপ ফলাফল করতে না পারে তবে তাদেরকে বাচাতে পারবে না কোন কিছুই।
- ‘লেভার’ এবং বার্সেলোনা
আগামী ২৫ বছরের লা লিগা সম্প্রচার সত্ত্বের ২৫ ভাগ বিক্রি করে দিয়ে বার্সেলোনা প্রায় ৫৮২ মিলিয়ন ইউরো তুলতে সক্ষম হয়েছে। বার্সা মার্চেন্ডাইজ এবং লাইসেন্সিং সত্ত্বের ৪৯.৯ ভাগ বিক্রি করে ক্লাবটি আরো আর্থ জোগাড় করবে বলে জানিয়েছে।
বার্সেলোনা তাদের ভবিষ্যৎ কে বিকিয়ে দিয়ে স্বল্প মেয়াদী সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এই গ্রীষ্মকালীন দলবদলের মৌসুমে বার্সা যেখানে পারছে সেখাই ‘লেভার’ ব্যাবহার করছে অর্থ যোগাড়ের জন্য এই আশায় যে ২০২২-২০২৩ মৌসুমে দল সাফল্য পাবে।
ক্লাবটি ধারণা করছে তারা একবার ম্যাজর শিরোপা জেতা শুরু করলে তাদের সকল দুর্দশা দূর হবে, তারা আবার ফুটবলীয় অর্থনীতির শীর্ষে পৌছে যাবে যেটা তাদের প্রাপ্য জায়গা। আধুনিক ফুটবলে দল সফল হলে যে টাকা আসবে তা সত্যি বই মিথ্যে নয়।
‘লেভার’ নীতি নৈতিক কিনা সেটা মূল কথা নয় বরং ফুটবল দুনিয়ায় নতুন এই নীতি অবলম্বন করে বার্সা কতটা সফল হয় সেটাই আসল কথা।
- বার্সার মার্কি সাইনিং
ক্রমাগত ঋণ নিয়ে এবং ভবিষ্যতের আয়কে বলিদান দিয়ে ক্লাবপরিচালনা করা মোটেও কার্যকর দীর্ঘ মেয়াদী কোন পদ্ধতি নয়। বার্সার মার্কি সাইনিং লেওয়ানডস্কি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। লাপোর্তা তাকে দলে ভিড়িয়েছেন তার পরিকল্পনা সফল করতে কিন্তু আসলেই কি দল বদলের বাজারে এই খেলোওয়াড়কে দলে ভেড়ানোর আদতে কোন প্রয়োজন ছিল বার্সার?
বার্সার একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের দরকার ছিল তাদের গোল করা কাটাতে যার জন্য তারা জানুয়ারি দলবদলের মৌসুমে পিয়ের এমেরিক আবেমেয়াংকে দলে ভেড়ায়, ক্লাবটির হয়ে ১৭ লিগ ম্যাচে ১১ গোল করেন তিনি।
প্রশ্ন উঠছে আবেমেয়াংকে দলে ভেড়ানোর পর লেওয়ানডস্কিকে কেনা কতটা যৌক্তিক ছিল। লেওয়ানডস্কি নি:সন্দেহে অবামিয়াং থেকে ভাল খেলোয়াড় কিন্তু আগামী মাসে ৩৪ বছর হতে যাওয়া এই আক্রমণ ভাগের খেলোওয়াড়ের পিছনে এত অর্থ খরচ করা ক্লাবটির অর্থনৈতিক পেশি প্রদর্শন ছাড়া বৈ অন্য কিছু হিসেবে মানতে নারাজ সবাই। সকলের কথা একটাই এই টাকা দলের অন্য জায়গায় খরচ করাই ছিল সবচেয়ে যৌক্তিক কাজ।
- দলবদলের প্রভাব
লেওয়ানডস্কিকে দলে ভেড়ানোতে ক্লাব সমর্থকরা খুব খুশি। ক্লাবের আর্থিক অবস্থার ব্যাপারে অনেক হতাশাজনক কথা শোনা সমর্থকদের জন্য এমন বড় মাপের খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানোর সংবাদ আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। ক্লাবের অর্থনীতিতে এই দলবদল কি প্রভাব ফেলবে সেই ব্যাপারে বেশীরভাগ সমর্থকের কোন মাথাব্যথা নেই।
পোলিশ আক্রমণভাগের এই খেলোওয়াড়কে দলে পেয়ে জাভি নিঃসন্দেহে খুশি। মাঝ মাঠে গ্যাভি, পেদ্রি এবং আক্রমণভাগে ফেরান টরেস, দেম্বেলে, রাফিনহারা যে তাকে গোল করার জন্য যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিবে তা বলাই যায়।
- রক্ষণের দৈন্যদশা
আক্রমণভাগে ভুরি ভুরি খেলোয়াড় কিনলেও বার্সার রক্ষণের দৈনদশা পুরোপুরি দূর হয়নি। ৩৩ বছর বয়সী জর্ডি আলবা এবং তরুণ সার্জিও ডেস্টের বদলে সিজার আজপেলিকুয়েটা এবং মার্কোস আলনসোকে দলে ভেড়ানোর তোরজোড় করছে ক্লাবটি।
রক্ষণকে মজবুত করতে বার্সা দলে আরো খেলোওয়াড়দের ভেড়াবে যখন ‘লেভার’ তৃতীয়বারের মত সক্রিয় করবে তারা। এরপর ব্যর্থ হওয়ার আর কোন অজুহাত থাকবে না লাপোর্তার কাছে, আর সাফল্লের মাধ্যমে তারা দলটির স্পনসর, ঋণদাতা এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রমান করতে পারবে একসময় মৃত প্রায় কাতালুনিয়ার ক্লাবটি আবার নিজের জায়গায় ফিরেছে।
কোন অদ্ভুত কারণে বার্সেলোনা যদি সফল হতে না পারে তবে দেওয়ালে মাথা ঠুকে কান্না করা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না কারণ দলকে বাচাতে আর কোন ‘লেভার’ চালু করার জন্য বেচে থাকবে না তখন।