সাবলীল সিরিল ওয়াশব্রুক

টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ওপেনিং জুটি নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করি, হেইডেন-ল্যাঙ্গার , গ্রিনিজ-হেইন্স বা গাভাস্কার-চৌহান বেশিরভাগ আলোচনা জুড়ে থাকে। কিন্তু একসময় ওপেনিং জুটিতে বিশ্বরেকর্ডের মালিক, হটন-ওয়াশব্রুক জুটি নিয়ে আমরা সেরকম আলোচনাই করিনা। হটন এবং ওয়াশব্রুক একসাথে ৫১ বার ওপেন করেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে, তাঁদের গড় ৬০।

এই জুটির অন্যতম পুরোধা সিরিল ওয়াশব্রুক জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালে ছয় ডিসেম্বর। ১৯৪৮ সালে জোহানেসবার্গের এলিস পার্ক মাঠে লেন হটন এবং ওয়াশব্রুক ৩৫৯ রান জুড়েছিলেন, যা তৎকালীন রেকর্ড ছিল এবং এখনো ইংল্যান্ডের রেকর্ড। সেই জুটিতে ওয়াশব্রুক করেন ১৯৫।

দীর্ঘ ৩১ বছর খেলেছেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, পুরোটাই ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে। ল্যঙ্কাশায়ারের প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি। বিখ্যাত আম্পায়ার ‘ডিকি’ বার্ডের যেমন ইয়র্কশায়ার অন্ত প্রাণ, হিডিংলিতে টেস্ট হলে এই বয়সেও মাঠে দেখা যায় তাঁকে। তেমনই ওয়াশব্রুক ছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ার অন্ত প্রাণ।

৮৫ বছর বয়সে মৃত্যু। তার কিছুদিন আগে অসুস্থতার পূর্বে ১৯৩৩ থেকে জড়িত ছিলেন এই ক্লাবের সাথে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ টেস্ট ম্যাচ ইনিংসটি খেলা ল্যাঙ্কাশায়ারের ‘চিরশত্রু’ ইয়র্কশায়ারের মাঠে। ১৯৪৮ সালে সেই ম্যাচে তাঁর করা ১৪৩ কে নেভিল কার্ডাস তাঁর দেখা অন্যতম ভুলত্রুটিহীন, স্বচ্ছ ইনিংস হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।

যদিও ব্রাডম্যান এবং মরিস ৪০৪ রানের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় খেলার ছলে তুলে দেন, নাহলে ওয়াশব্রুকের ওই ইনিংস নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হবার কথা। ইয়র্কশায়ারের সাথে ওয়াশব্রুকের ক্রিকেট জীবনের যেন এক অদ্ভুত যোগ ছিল।

এই ব্যাপারে একটা ঘটনা না বললেই নয়।

১৯৫৬ সালের অ্যাশেজ চলছে। ইয়র্কশায়ারের ঘরের মাঠ লিডসে লেকার খ্যাত সেই অ্যাশেজ সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। প্রথম দুটো টেস্টের পর ইংল্যান্ড পিছিয়ে রয়েছে ১-০ ব্যবধানে। তার বছর পাঁচেক আগে অবসর নেয়া ওয়াশব্রুক তখন নির্বাচক।

তৃতীয় টেস্টের আগে, বাকি নির্বাচকরা তাঁকে বলেন, ‘তুমি ভাই নির্বাচক প্যানেল থেকে বেরিয়ে আমাদের হয়ে টেস্ট সিরিজটা খেলে দাও।’ মনে রাখতে হবে, ওয়াশব্রুক তখন ৪১, আর যদিও কাউন্টি খেলছেন, কিন্তু বেনো-লিন্ডবল-মিলার খেলা তো ঠিক কাউন্টি খেলা না।

যাই হোক, বহু বলে কয়ে তাঁকে রাজি করানো গেলো। যখন নামলেন, তখন ইংল্যান্ড ১৭ রানে ৩ উইকেট। এমনিতে ওপেনার সিরিলকে টিম ম্যানেজমেন্ট লজ্জা থেকে বাঁচাতেই কিনা কে জানে, ওপেন করতে দেয়নি। ১৭ রানে ৩ উইকেট অবশ্য এক প্রকার ওপেনিংই। সেখান থেকে অধিনায়ক পিটার মের সাথে জুটি বেঁধে ইংল্যান্ডকে উদ্ধার করলেন। নিজে করলেন ৯৮।

লেকারের তারাবাজিতে সেই টেস্ট জিতে নেয় ইংল্যান্ড, কিন্তু ওয়াশব্রুকের ৯৮ না থাকলে কি হতো বলা মুশকিল। সেই সিরিজের বাকি ম্যাচ গুলোতেও ভালো খেলেন ওয়াশব্রুক, এবং সেটি তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ হয়ে রয়ে যায়। ইংল্যান্ড ওয়াশব্রুকের রাস্তা ধরেই এরপর বহুবার বিপন্ন সময়ে সাবেকদের ধরে এনেছে, কলিন কাউড্রে এবং হোল্ডিংয়ের বাউন্সারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলতে নামা বৃদ্ধ ব্রায়ান ক্লোস যার অন্যতম উদাহরণ।

সিরিল ওয়াশব্রুকের টেস্ট আবির্ভাব ঘটে ১৯৩৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অভিষেকে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ডেনিস কম্পটন। ডেনিস কম্পটনের মতো সুন্দর ব্যাটিং করতেন না ওয়াশব্রুক। ডেনিস কম্পটনের মতো সুন্দর ড্রাইভও মারতে পারতেন না তিনি। কিন্তু উপযোগিতায় যথেষ্ট ভালো ছিলেন ওয়াশব্রুক। পুল-কাট এবং হুক বেশ ভালো মারতেন তিনি।

তৎকালীন বহু ভালো খেলোয়াড়ের মত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কেড়ে নেয় তাঁর খেলোয়াড় জীবনের সেরা সময়টা। ২৫ থেকে ৩১-যে সময়টা একজন ব্যাটসম্যানের জীবনের সেরা সময় হতে পারতো সেই সময় তিনি সেনাবাহিনীদের শারীরিক শিক্ষার ট্রেইনার ছিলেন। এই কারণেই কিনা কে জানে, ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ফিল্ডার ছিলেন ওয়াশব্রুক। কভার অঞ্চলে তাঁর ফিল্ডিং এবং থ্রোয়িং তৎকালীন ক্রিকেটে সেরা ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link