৪৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস। ছিমছাম একটি ইনিংস। তবে বাটলারের খেলা ৭ চার আর ২ ছক্কায় সাজানো এই ইনিংসটিই যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মহা গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে। আগের দুই ম্যাচে ইংলিশ এই অধিনায়কের ব্যাট হাসেনি।
তবে একদম বাঁচা মরার লড়াইয়ের ম্যাচে এসেই খেললেন অধিনায়কোচিত এক ইনিংস। একদম মোক্ষম সময়ে ফিরে আসা যাকে বলে। আর এ ম্যাচ দিয়েই দ্বিতীয় ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবে ইয়ন মরগ্যানের পর শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার মাইলফলক স্পর্শ করলেন জশ বাটলার।
ইয়ন মরগ্যানের পাশে কীর্তিতে নাম লেখানোর দিনে বাটলার সেই মরগ্যানেরই আরেকটি রেকর্ড ভেঙেছেন। ৭৩ রানের ইনিংস খেলার ফলে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে বাটলারের রান এখন ২৪৬৮। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি এর আগে ইংলিশ ব্যাটারদের মধ্যে মরগানের করা সর্বোচ্চ ২৪৫৮ রানের রেকর্ডটি ভেঙে দিয়েছেন। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার হলেন জস বাটলার।
যাহোক, কীর্তি, রেকর্ডের ভিড়ে বোধহয় কিউইদের বিপক্ষে তাঁর ৭৩ রানের ইনিংসটি বড্ড আড়ালে চলে যাচ্ছে। তবে ম্যাচের পরিস্থিতি কিংবা ম্যাচ বিবেচনায় বাটলারের খেলা এ ইনিংসটির গুরুত্ব অনেক। কারণ সেমির দৌড়ে টিকে থাকতে হলে এ ম্যাচটিতে জিততেই হতো বাটলারদের। আর বাটলার এমন ডু অর ডাই পরিস্থিতিই দুর্দান্ত এ ইনিংসটি খেলেছেন। একই সাথে অধিনায়কত্বের জগতে আনকোরা হলেও মাঠে দেখিয়েছেন কাপ্তানির সুনিপুণ মুনশিয়ানা।
সার্বিকভাবে ৪৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংসটি দেখতে যতটা দুর্দান্ত লাগছে, ইনিংসের শুরুর দিকটা কিন্তু অতটা আগ্রাসনের ছিল না। এ দিনে প্রথম দিকে বাটলারের ব্যাটে রান এগিয়েছে একদম মন্থর গতিতে। ক্যারিয়ারজুড়ে যার স্ট্রাইকরেট ১৪৪, সেই বাটলারই কিউই বোলারদের বিপক্ষে ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে ছিলেন বাউন্ডারি শূণ্য।
দলীয় ইনিংসের ১০ ওভার পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখন পর্যন্ত বাটলার নিজের খোলস ছাড়েননি। ২৬ বলে ৩১ রান নিয়ে আছেন ক্রিজে। মূলত গ্যাবার কঠিন পিচের জন্য তাঁর এমন পরিকল্পনা। গ্যাবার মাঠে রান আসে। তবে বাউন্ডারি বের করে রান তোলাটা কঠিন। বড় বাউন্ডারির মাঠে তাই প্রথম দিকে ঝুঁকি নিতে চাননি বাটলার। আর তাঁর ঐ সাবধানী শুরুর পরিকল্পনাটাও বেশ কাজে দিয়েছে।
অবশ্য বিধ্বংসী রূপে তার বাটলারের আবির্ভাব ঘটেছিল কিছুক্ষণ বাদেই। প্রথম দিকে ২৬ বলে ৩১ করা বাটলার পরে ২১ বলে তোলেন ৪২ রান। আর সেখান থেকেই ইংল্যান্ড ইনিংসের মোড় ঘুরে যায়। স্কোরবোর্ডে তারা তুলতে পারে ১৭৯ রান।
তবে বাটলারের এই ইনিংসের সাথে আরেকটি যোগসূত্রও ঘটেছে ম্যাচে। এ দিনে তিন নম্বরে তিনি ব্যাটিংয়ে আনেন মইন আলীকে। এ ছাড়া হ্যারি ব্রুককে নিয়ে আসেন বেন স্টোকসেরও আগে। আর নিয়মিত তিন নম্বরে খেলা মালানকে নামিয়েছিলেন নাম্বার আটে।
মূলত ম্যাচ পরিস্থিতিতেই তাঁর এমন অদল বদল। এমন অদল বদলে বাটলারের ব্যাটিংয়ের সাথে সিনক্রোনাইজেশনও হয় দারুণ।
একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মালান শুরুটা করেন রয়ে শয়ে। কিন্তু ইংল্যান্ড ইনিংসে যখন প্রথম উইকেটের পতন হয় তখন প্রায় ইনিংসের অর্ধেক শেষ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ মালানের রোলটা ততক্ষণে কেউ একজন করা শুরু করে দিয়েছেন। তাই উইকেটে এমন একজনকে দরকার ছিল যিনি পাওয়ার হিটিংয়ে দক্ষ।
এজন্য তিনে আনা হয় মইন আলীকে। মইন আলী অবশ্য সফল হননি। কিন্তু সেই চাওয়াটা পূরণ করেছিলেন পরের উইকেটে আসা ব্যাটার লিয়াম লিভিংস্টোন। ২০ রানের ছোট্ট একটি ক্যামিও খেলেন তিনি। আর ইংল্যান্ডের ঐ সময়ে এমন একটা ইনিংসই দরকার ছিল।
এখানেই শেষ নয়। কিউইদের ব্যাটিং ইনিংসের শুরুতেই বাটলার বল হাতে তুলে দেন মইন আলীকে। আর ইনিংসের শুরু থেকেই বোলারদের রোটেট করতে থাকেন তিনি। প্রথম ৭ ওভারের মাঝেই তিনি ব্যবহার করেন ৬ বোলার।
ক্রমাগত এমন পরিবর্তনের কারণে কিউই ব্যাটাররাও বেশ হিমশিম খেতে শুরু করে। পাওয়ার প্লে’র মাঝেই তারা হারিয়ে ফেলে দুই ওপেনার কনওয়ে আর ফিন অ্যালেনের উইকেট। আর সেখান থেকে আর ঘুরে দাড়াতে পারেনি নিউজিল্যান্ড। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান গ্লেন ফিলিপস এ ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করলেও শেষ পর্যন্ত কিউইরা ম্যাচটি হেরে যায় ২০ রানে।
দারুণ ইনিংসের পর বাটলারের এমন ক্যাপ্টেন্সি নজর কেড়েছে অনেকের। তবে বাটলার এখানে নিজেকে কৃতিত্ব দিতে নারাজ। তিনি বলেন, আপনি যে পরিকল্পনা করবেন সেটা যে সব সময়ই ফলপ্রসু হবে তা নয়। তবে সীমিত ওভার ক্রিকেটে ঝুঁকি না নিলে যে কোনো পরিস্থিতি ম্যাচ জেতার অভ্যাস তৈরি হয় না। আমি অধিনায়কত্বে বেশ নতুন। আমার এখনও অনেক কিছু শেখার আছে, বহু জানার আছে।
বোলিং প্লেসমেন্ট নিয়ে বাটলার আরও যুক্ত করেন, ‘আমি প্রতিটা বোলারকেই আগে থেকেই নির্দেশনা দিয়ে থাকি যে তাদের যে কোনো সময় বোলিং করা লাগতে পারে। আর এটাই তাদের আরও ভালভাবে প্রস্তুত করেছে এবং মানসিকভাবে আরও দৃঢ করেছে।’
শুরুর দিকে বেশ ধীর গতিতেই ব্যাটিং করেছিলেন বাটলার। শুরুর পেসে কি তবে বাটলারকে একটু অস্বস্তিতে ফেলেছিল? বাটলার অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, মাঠে আমি যতটা সম্ভব সময় কাটাতে চেয়েছি। এছাড়া কিছু নয়।
সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে সামনে আরেকটি বাঁধা পার হতে হবে ইংলিশদের। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাদের বিপক্ষে তাদের জিততেই হবে। এমন সমীকরণে অবশ্য চাপ অনুভব করেন না বাটলার। তিনি বলেন, এতে বরং কিছু সুবিধা আছে। আপনি আপনার লক্ষ্য নিয়ে খেলতে পারবেন। তাই আমরা ম্যাচটার জন্য অপেক্ষা করছি। দেখা যাক কী হয়।
৪ ম্যাচে দুই জয়, এক হার আর বৃষ্টিতে পরিত্যাক্ত হওয়া এক ম্যাচ মিলিয়ে মোট ৫ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট তালিকায় ২ নম্বরে আছে ইংল্যান্ড। রান রেটেও আছে সুবিধাজনক অবস্থানে। তবে সমীকরণের কোনো তোয়াক্কা না করে সেমিতে যেতে হলে লঙ্কানদের বিপক্ষে তাদের জিততেই হবে। নাহলে অনেক ‘যদি’, ‘কিন্তু’র উপর আঁটকে থাকবে ইংলিশদের সেমির যাত্রা। জস বাটলার, বেন স্টোকসরা নিশ্চয় সেই সুতোয় ঝুলে থাকতে চাইবেন না।