১.
‘এগারো জনের বিরুদ্ধে এগারো জন মিলে একটা বলের পেছনে ধাওয়া করে চলার মধ্যে কোনও সৌন্দর্য্যই নেই। ফুটবল জনপ্রিয় কারণ নির্বুদ্ধিতাও জনপ্রিয়।’ – আর্জেন্টিনার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক জর্গে লুই বোর্হেসের উক্তি। ১৯৭৮-এ স্বদেশে আয়োজিত বিশ্বকাপের সমস্ত আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। অবশ্য ৭৮-এর বিশ্বকাপ জয়ী টেকনিক্যাল ডিরেক্টর লুই সিজার মেনোত্তির আমন্ত্রণে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বোর্হেস ভেবে পাচ্ছিলেন না, একজন এত বুদ্ধিমান লোক কী করে সারাক্ষণ ফুটবলের মত এমন একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে পারেন!
বোর্হেস চলে গেলেন ১৯৮৬ এর ১৪ই জুন। ঠিক পনেরো দিন বাদে মেক্সিকোয় দিয়েগো মারাদোনার হাত ধরে এল আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। ‘নির্বুদ্ধিতা’র লেলিহান ইশতেহার হয়ে মারাদোনা ছড়িয়ে পড়লেন বিশ্বের প্রান্তরে প্রান্তরে; পরের ইতালি বিশ্বকাপ-সহ ন্যাপোলির গৌরবগাথা স্থান করে নিল ফুটবল ইতিহাসে, একধরনের প্যারাডাইম শিফট হিসেবে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে ফুটবল জনতার নয়নের মণি ব্রাজিলের সমর্থনকে আড়াআড়ি ভাগ করে দিলেন তিনি। কোপা আমেরিকায় আধিপত্য দেখানো আর্জেন্টিনা বিশ্বকেও দেখাল অসীম সম্ভাবনা।
দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের বছরপূর্তির পাঁচ দিন আগে রোজারিও শহরে জন্ম নিল এক শিশু।
২.
এনগ্যাঞ্চে (Enganche)- আর্জেন্টিনা ফুটবলের এক উল্লেখযোগ্য পরিভাষা। মিডফিল্ড আর আক্রমণের সেতু সংযোগকারী খেলোয়াড়। সে সমস্ত ডিফেন্সিভ রোল থেকে মুক্ত, অথচ তার পায়েই দলের মূল ছন্দ নিয়ন্ত্রিত হয়, সে যেভাবে চালাতে চায় দলের খেলা সেভাবে আন্দোলিত হয়। আর্জেন্টিনার ক্ল্যাসিক নাম্বার টেন।
৮৬ বিশ্বকাপের জয়ী দলের সদস্য ভালদানো একবার বলেছিলেন বহমান সঙ্গীতের মধ্যে হঠাৎ সাময়িক থমকে যাওয়ার যেমন ভূমিকা আছে ফুটবলেও সেরকম বিরতি প্রয়োজন। ছুটতে থাকা এনগ্যাঞ্চে হঠাৎ করে থমকে গিয়ে সতীর্থ খেলোয়াড়দের অবস্থান দেখে নিয়ে গোলের ঠিকানা লেখা পাস বাড়াতে পারেন, এই ছোট্ট বিরতির আকাঙ্ক্ষাটুকু আর্জেন্টিনার ফুটবল দর্শকদের পরম তৃপ্তি দেয়, এর নাম la pausa (অর্থাৎ, the pause)। এই la pausa ঘটে যাওয়ার মুহূর্তেই ইউরোপীয় ফুটবলের অবিশ্রান্ত দৌড়-দৌড়-দৌড় এর থেকে আর্জেন্টিনার ফুটবল স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে।
সাতের দশকে আর্জেন্টিনার ফুটবলে রিকার্দো বোচিনি ছিলেন এনগ্যাঞ্চে-র প্রকৃষ্ট নির্দশন। তাঁকে আদর্শ করেই মারাদোনার বেড়ে ওঠা। ৮৬-র বিশ্বকাপে জাতীয় দলের কোচ বিলার্দো মারাদোনার এনগ্যাঞ্চে হিসেবে খেলার সামর্থ্যকে সর্বোচ্চ স্তরে কাজে লাগালেন, বাকিটা ইতিহাস। ম্যারাডোনার কেরিয়ার যখন শেষের দিকে তখন থেকেই আর্জেন্টিনা ফুটবলে নতুন এনগ্যাঞ্চের বদলে বেশি করে খোঁজ শুরু হল ‘নতুন মারাদোনা’-র। মারাদোনার খেলার সঙ্গে সাদৃশ্য এবং চরম বৈসাদৃশ্য মিলে পুরো নব্বইয়ের দশক আর একুশ শতকের প্রথম দশক জুড়ে উঠে আসতে থাকল একাধিক নাম – দিয়েগো লাতোরে, এরিয়েল ওর্তেগা, মার্সেলো গ্যালার্দো, হুয়ান রোমান রিকেলমে, পাবলো আইমার, হাভিয়ের স্যাভিওলা, ডি আলেসান্দ্রো, কার্লোস তেভেজ এবং আরও অনেক ‘নতুন ম্যারাডোনা’!
৩.
১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার খেলার কথা ছিল না। ততদিনে তিনি অবসরে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ এ কোপা আমেরিকা জয়ের পরেও বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার্সে খারাপ খেলে অটোমেটিক বার্থ হারানো আর্জেন্টিনার জন্য শেষ সুযোগ ছিল প্লে-অফ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ খেলার জন্য অনেক অনুরোধ মিনতির শেষে মারাদোনা রাজি হয়েছিলেন ফিরতে, নিউ ওয়েলস ওল্ড বয়েজ এর হয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নিজেকে ম্যাচ ফিট করে তোলার।
২৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফিটনেস লেভেল বাড়িয়ে অধিনায়ক হয়েই ফিরলেন তিনি, আর্জেন্টিনা দুই ম্যাচের টাইয়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে নিশ্চিত করল বিশ্বকাপে যাওয়া। অথচ শেষে অপেক্ষা করেছিল নির্মম পরিণতি। গ্রিসের বিপক্ষে নতুন তারকা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার হ্যাটট্রিকের খুশির রেশ কাটতে না কাটতেই ড্রাগ টেস্টে পাশ করতে ব্যর্থ ম্যারাডোনার জন্য নেমে এল নির্বাসন, বিশ্বের ফুটবল প্রেমীদের চোখের জলে ভাসিয়ে শেষ হল আর্জেন্টিনার জার্সিতে মারাদোনার অধ্যায়, আর্জেন্টিনাও থামল রাউন্ড অব সিক্সটিনেই। সেই বিশ্বকাপেই আত্মপ্রকাশ ঘটল নতুন ম্যারাডোনা ওর্তেগার।
১৯৯৮-এ আশা জাগিয়ে শুরু করেও ডেনিস বার্গক্যাম্পের চোখ ধাঁধানো গোলে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান থেমে গেল। মারাদোনাহীন সেই বিশ্বকাপে ১০ নম্বর জার্সির ওর্তেগা ভাল খেললেও স্মরণীয় হয়ে রইলেন ডাচ গোলকিপার ভ্যান ডার সারকে ঢুঁসো মেরে লাল কার্ড দেখার জন্য! এই বিশ্বকাপে তাঁর পাশাপাশি খেললেন আরেক নতুন মারাদোনা গ্যালার্দোও।
৪.
ব্রিটিশ ফুটবল লিখিয়ে জোনাথন উইলসন লিখছেন, আশির দশকের শেষ থেকে ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশে বসে বিশ্ব ফুটবলের ভবিষ্যত রাস্তা তৈরি করছেন দুই ফুটবল পাগল একবজ্ঞা ফুটবল চিন্তক। হল্যান্ডের লুই ভ্যান গাল আর আর্জেন্টিনার মার্সেলো বিয়েলসা। আর্জেন্টাইন ফুটবলে মেনোত্তি ও বিলার্দোর নিজস্বতা পেরিয়ে তৈরি হচ্ছে এক পৃথক ধারা।
আক্রমণাত্মক ফুটবলের এই ধারা নির্মাণে গুরুত্ব পাচ্ছে ভিডিও অ্যানালিসিস-সহ ইনফরমেশনের যোগান, প্রবল ওয়ার্করেট, প্রচন্ড ইন্টেন্স ট্রেনিং পদ্ধতি, প্রেসিং, মাল্টি ফাংশনালিটি প্রভৃতি একাধিক ইউরোপীয় ধারণা। একই সঙ্গে উরুগুয়ের অস্কার তাবারেজ, ইতালির আরিগো সাচ্চি এবং হল্যান্ডের লুই ভ্যান গাল অনুপ্রাণিত করছেন বিয়েলসাকে। আলফিও বাসিলের মত আর্জেন্টিনার ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার ফুটবল পন্থীরা খানিক বিমর্ষ হচ্ছেন।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের শেষে পেকেরম্যানের সুপারিশে জাতীয় দলের দায়িত্ব নিচ্ছেন বিয়েলসা। ট্রেনিংয়ে আসছে ‘মার্ডার বল’, দৌড় না থামিয়ে ৫-২০ মিনিট নিরন্তর ছুটে চলা। চার বছরের তুখোড় প্রস্তুতি শেষে আর্জেন্টিনা ফেভারিট হিসেবে শুরু করছে ২০০২ বিশ্বকাপ অভিযান, কোয়ালিফায়ার্সে প্রথম হয়ে। প্রত্যাশিত পারফরম্যান্সের ধারে কাছেও না গিয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আর্জেন্টিনা বিদায় নিচ্ছে গ্রুপ রাউন্ড থেকেই। দুই নতুন মারাদোনা এরিয়েল ওর্তেগা আর পাবলো আইমার খেলার সুযোগ পাচ্ছেন, বেঞ্চে বসে থাকছেন মার্সেলো গ্যালার্দো। আর সিস্টেমের সঙ্গে মানানসই না হওয়ার কারণে বিশ্বকাপের বাইরে বসে কাটাচ্ছেন ফ্যান ফেভারিট হুয়ান রোমান রিকলমে। ফের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ শেষ হয়ে যাচ্ছে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, দিয়েগো সিমিওনে সহ কয়েকজনের।
বিশ্বকাপে ভরাডুবির পরেও দায়িত্বে বহাল থাকা বিয়েলসা সহকারী ক্লদিও ভিভাসকে নিয়ে পাগলের মত অন্বেষণ করে চলেছেন নতুন প্রতিভা। এই সময়েই তাঁরা খুঁজে পাবেন হাভিয়ের মাসচেরানোকে। রিভার প্লেটের হয়ে সুযোগ পাওয়ার আগেই সিনিয়র জাতীয় দলে সুযোগ মিলবে তাঁর! একই সঙ্গে বার্সেলোনার এক ষোড়শ বর্ষীয় তরুণের কথা বিয়েলসাদের কানে এসেছে ততদিনে। বার্সেলোনার এক হোটেলে খানিক গোপনেই থাকার সময়ে তাঁদের কাছে আসছে সেই ছেলের ভিডিও টেপ, জনৈক আর্জেন্টাইন জর্গে তাঁদের অনুনয় করছেন জাতীয় দলে ওকে সুযোগ দিতে, নইলে স্পেন নিয়ে নেবে এই প্রতিভাকে।
ভিডিও দেখে চমকে উঠছেন বিয়েলসা, তারপরে ভিভাসকে বলছেন, ‘স্পিড কমাও ভিডিওটার, ভাল করে দেখা যাচ্ছে না ওর খেলা’। তাঁকে অবাক করে দিয়ে ভিভাস বলছেন, স্পিড তো ঠিকই আছে, ছেলেটার গতিই বিস্ময়কর!
এরপরেই দুজনেরই সম্মতিতে সেই ভিডিও টেপ চলে যাচ্ছে অনূর্ধ্ব ২০ জাতীয় দলের দায়িত্বে থাকা সহকারী হুগো তোকাল্লির কাছে। ‘যেন স্পেন ছিনিয়ে না নেয় এই ছেলেটাকে! একটু দেখুন প্লিজ!’
৫.
১৯৯৪ সালে খানিক সমালোচনার মধ্য দিয়েই আর্জেন্টিনার যুব ফুটবলের দায়িত্ব দেওয়া হল হোসে পেকেরম্যান এবং তাঁর সহকারী হুগো তোকাল্লির হাতে। ১৯৭৮ আর ১৯৮৬ বিশ্বকাপ এবং ১৯৭৯ যুব বিশ্বকাপ জিতলেও ধারাবাহিক ভাবে তরুণ প্রতিভা তুলে আনার ক্ষেত্রে আটের দশকে আর্জেন্টিনা খানিক ব্যর্থই হচ্ছিল, ৯১ যুব বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের ব্যবহারও প্রশ্নের মুখে পড়ে।
পেকেরম্যানের তত্বাবধানে স্কাউটিং গ্রুপ একাধিক তরুণ প্রতিভাকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের ইন্ডিভিজুয়াল ডেভেলপমেন্টের কর্মসূচি নিল। বিভিন্ন পজিশন এবং বিভিন্ন রোল ভিত্তিক ফুটবলারদের বড় মঞ্চে খেলার জন্য তৈরি করা শুরু হল। এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ফসল হিসেবে পরের সাতটা বিশ্বকাপের মধ্যে ৫টা বিশ্বকাপই এল আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ২০ দলের দখলে।
১৯৯৭ যুব বিশ্বকাপ জিতে ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে উঠে এলেন আইমার, রিকলমে, ওয়াল্টার স্যামুয়েল এবং ক্যাম্বিয়াসো। এই স্কোয়াডেই ছিলেন লিওনেল স্ক্যালোনিও। ২০০৬ বিশ্বকাপ স্কোয়াডের খেলোয়াড়দের একটা বড় অংশই উঠে এসেছিলেন পেকেরম্যানের তৈরি করা সেট আপের মধ্যে থেকেই।
পেকেরম্যানের কোচিংয়ে এল তিন যুব বিশ্বকাপ, ২০০৪ এ তিনি আর্জেন্টিনার সিনিয়র জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরে যুব দলের কোচ হন হুগো তোকাল্লি, তাঁর হাত ধরে এল আরও দুই যুব বিশ্বকাপ। ২০০২-এ যার ভিডিও টেপ হাতে এসেছিল তোকাল্লির সেই বিস্ময় প্রতিভাই ২০০৫ যুব বিশ্বকাপ এনে দিল আর্জেন্টিনাকে। বার্সেলোনা ক্লাবের বিস্ময় প্রতিভা, রোজারিওর ছেলে লিওনেল মেসি।
৬.
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ। পেকেরম্যানের ছেলেরা। আয়ালা, সোরিন, স্যভিওলা, ম্যাসচেরানো, ক্যাম্বিয়াসো, ক্রেসপো, আইমার, তেভেজ, রদ্রিগেজ এবং এবং এবং ম্যাজিশিয়ান রিকলমে। ক্ল্যাসিক এনগ্যাঞ্চের প্রত্যাবর্তন। গ্রুপ লিগ। ২৬ পাস। গোল। ক্যাম্বিয়াসোর উচ্ছ্বাস। আর্জেন্টিনা ৬-০ সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো। ১৯ নম্বর জার্সির ১৯ বছরের লিও মেসির শেষ গোল।
কোয়ার্টার ফাইনাল। বিপক্ষ জার্মানি। রিকলমের কর্নার। আয়ালার অবিশ্বাস্য হেড। গোল। বলের দখল আর্জেন্টিনার। সাবস্টিটিউসন। রিকলমে আউট। গোলকিপার আহত, আউট। ক্রেসপো আউট। অব্যাহত জার্মানির আক্রমণ। মাইকেল বালাক। বোরোস্কির হেডে দারুণ ফ্লিক। মিরোস্লাভ ক্লোজে হেড। গোল শোধ। একস্ট্রা টাইম, টাইব্রেকার। লেম্যানের চিরকুট। আয়ালা মিস, ক্যাম্বিয়াসো মিস। ক্যাম্বিয়াসোর কান্না। স্বপ্নভঙ্গ। পেকেরম্যানের পদত্যাগ।
গার্ডিয়ান পত্রিকায় পল ডয়েলের আর্টিকল: ‘Argentina blow it with crazy substitutions Jose Pekerman sabotaged his own side, and that’s why they lost to Germany’
সাবস্টিটিউট বেঞ্চে সেদিন বসে দুই লিওনেল। লিওনেল মেসি এবং লিওনেল স্ক্যালোনি।
৭.
‘১৯৮৬ সালে দেশবাসীকে আনন্দ উপহার দিয়েছি, সুযোগ এসেছে কোচ হয়েও দেশকে কিছু দেওয়ার’। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের খানিক টলোমলো অবস্থায় ২০১০ বিশ্বকাপের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন ডিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা। ততদিনে লিওনেল মেসিকে চিনে ফেলেছে গোটা বিশ্ব। শুরু হয়েছে মারাদোনার খেলার সঙ্গে তুলনাও। আর্জেন্টিনায় বেড়ে ওঠা সমস্ত ‘নতুন মারাদোনা’কে ততদিনেই ছাপিয়ে যেতে শুরু করেছেন ১৩ বছর বয়স থেকে বার্সেলোনায় বেড়ে ওঠা মেসি।
ম্যারাডোনা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বেপরোয়া ঢংয়ে শোনালেন যুগের সঙ্গে বেখাপ্পা এক আশ্বাসবাণী – ‘ট্যাকটিক্স আপেক্ষিক ব্যাপার, দলে ভাল খেলোয়াড় থাকলেই চলবে।’ প্রমাদ গণলেন ভালদানোর মত প্রাক্তনেরা। তবে তিনি ফুটবল ঈশ্বর, অসম্ভবের ছন্দেতে তিনি যদি সত্যিই কিছু ঘটিয়ে ফেলেন! আর্জেন্টিনা আশায় বুক বাঁধল নতুন করে। মারাদোনা মেসিকে দিলেন অবাধ স্বাধীনতা, মেসি খেললেন দুরন্ত গতিতে।
সেই বিশ্বকাপে মেসি গোল করালেও খানিক আশ্চর্য জনক ভাবে তাঁর নিজের নামের পাশে একটাও গোল লেখা হল না, খানিকটা বিপক্ষের গোলকিপারদের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে, খানিকটা ভাগ্যের অভাবে। তবে একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার মেসি নির্ভরতার বোধহয় সেই সূত্রপাত। একাধিক খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও প্রতিটা আক্রমণ মেসির মাধ্যমে গড়ে তোলার যে চেষ্টা চলছিল তাতে আধুনিক সিস্টেম নির্ভর ফুটবলের সঙ্গে পারার কথা না। ফলে, দলগত ভাবে অনেক এগিয়ে থাকা জার্মানির কাছে পর্যুদস্ত হতে হল আর্জেন্টিনাকে। মারাদোনাও পদত্যাগ করলেন, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাক্ষুষ করার আকাঙ্ক্ষা কার্যকর হল না, বরং, ইতিউতি ফিসফাস শুরু হল, ‘মেসি আর যাই হোক ম্যারাডোনা নয়’।
৮.
১৯৯৩ এ শেষবারের মত কোপা আমেরিকা জয়। আর্জেন্টিনার ঝুলিতে একুশ শতকের প্রাপ্তি বলতে দুই অলিম্পিকে সোনা। দুই কোপা ফাইনাল এবং কনফেডারেশন কাপ ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হার থেকে শুরু করে পরপর তিন বিশ্বকাপের ব্যর্থতা মেনে নেওয়া বড় সহজ ছিল না। বিশ্ব ফুটবলে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পেপ গার্দিওলা আর হোসে মোরিনহোর মগজাস্ত্রের লড়াইয়ে পেছনে চলে গেছেন বিগত দিনের ফুটবল চিন্তকেরা।
নতুন ফুটবল শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে স্পেন; লাতিন আমেরিকার ফুটবল ঘরানার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে রয়েছেন কিছু ফুটবলার, কিন্তু ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে শিল্প বনাম শক্তির লড়াইয়ের গল্প। ততদিনে জাতীয় দলকে একে একে বিদায় জানিয়েছেন রিকলমে, আইমার, আয়ালা, স্যামুয়েল, ক্রেসপো সহ আর্জেন্টিনার সোনালি প্রজন্মের একাধিক খেলোয়াড়। আর্জেন্টিনা কি আর কখনও ফিরে আসতে পারবে বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা শক্তি হিসেবে?
৯.
আরও এক কোপা আমেরিকায় খারাপ ফল। ফের কোচ বদল। ২০১১ এ আলেহান্দ্রো সাবেলা দায়িত্ব নিয়ে মেসির হাতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড তুলে দিলেন। ১৪-এর বিশ্বকাপে সাবেলা এগোলেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, ডিফেন্সকে আঁটোসাঁটো করে। মেসিকে ফ্রি খেলানোর দায়িত্ব পড়ল দীর্ঘদিনের যোদ্ধা হাভিয়ের মাসচেরানো এবং লুকাস বিগ্লিয়ার ওপর। অন্য দিকে মেসিকে আক্রমণে সাহায্য করার জন্য রইলেন ডি মারিয়া, হিগুয়েন কিংবা লাভেজ্জি ও আগুয়েরোর মত খেলোয়াড়। গ্রুপ লিগের বাধা মেসি কার্যত একার হাতেই পার করলেন। আর্জেন্টিনার দলগত সংহতি ক্রমশ বাড়তে লাগল। প্রায় দুর্ভেদ্য হয়ে উঠল গ্যারে, দেমিকেলিস, জাবালেতা, রোহোদের নিয়ে গড়া ডিফেন্স, গোলকিপার রোমেরোও ততদিনে প্রাথমিক নড়বড়ে ভাব কাটিয়ে যথেষ্ট ভরসা দিচ্ছেন।
প্রি কোয়ার্টারে দি মারিয়া আর কোয়ার্টারে হিগুয়েনের গোল ধরে রেখে আর্জেন্টিনা এগোল। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে জয়ের ম্যাচে অমর হয়ে রইল মাসচেরানোর জীবনপণ ট্যাকলে রবেনের গোলমুখী শট ব্লকের মুহূর্ত।
২৪ বছর পরে ফাইনালে উঠল আর্জেন্টিনা। ২৮ বছর পরে বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ। মেসি কি পারবেন ম্যারাডোনার উত্তরাধিকার বহন করতে?
ব্রাজিলকে ৭ গোলে হারানো ভয়ঙ্কর জার্মানির বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা লড়াই করল ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। হিগুয়েন আর পালাসিও গোলের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করলেন, মেসির শটও অল্পের জন্য গোলপোস্টের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এতেই হয়তো ঠিক হয়ে গেছিল ম্যাচের ভাগ্য। ১১৩ মিনিটে সুপার সাব মারিও গোৎজে যখন জার্মানির পক্ষে জয়সূচক গোলটা করলেন তখন আর্জেন্টিনার ডিফেন্স হতভম্ব।
এত কাছে তবু এত দূরে! বিশ্বকাপ অধরাই থেকে গেল। মেসি খানিক বিতর্কিত ভাবেই জিতলেন গোল্ডেন বল। কিন্তু বিশ্বকাপ ট্রফির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর শূন্যতা মাখা পাংশুটে মুখের ছবি বুক বিদীর্ণ করে দিল সমর্থকদের। মেসি বোধহয় ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবেন ইতিহাসে!
২০১৪ আরেকবার শুনিয়ে গেল বিচারের বাণী… ‘মেসি আর যাই হন না কেন ম্যারাডোনা নন’।
১০.
শুধু একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল নয়। ২০১৫ আর ২০১৬য় টাটা মার্টিনোর কোচিংয়ে, মেসির অধিনায়কত্বে পরপর দুটো কোপা আমেরিকা ফাইনালে উঠল আর্জেন্টিনা। চিলির কাছে দুবারই টাইব্রেকারে হারলেন মেসিরা। শেষ কোপার ফাইনালে মেসির পেনাল্টি ক্রসবারের অনেক ওপর দিয়ে চলে গেল, কান্নায় ভেঙে পড়া মেসি জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। সোশ্যাল মিডিয়া উপচে পড়ল ট্রোলে। আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা কার্যত ডুবে গেলেন হতাশায়! আর কতবার? ৯৩-এর পর থেকে ফাইনাল ম্যাচ মানেই হার, ছ-ছয়টা ফাইনালেই এক ছবি। এর কি কোনও শেষ নেই?
২০১৮-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার যোগ্যতা অর্জন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। বহু অনুনয়ে অবসর ভেঙে মেসি ফিরে এসেছিলেন আগেই, ইকুয়েডরের সঙ্গে বুকে কাঁপুনি ধরানো ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে দলকে আবার বিশ্বকাপে তুললেন। তবে সেবার আর্জেন্টিনা সমর্থকেরা বিশ্বকাপ থেকে বিশেষ কিছু প্রত্যাশা করেননি। আর্জেন্টিনা ঘরে ফিরল তাড়াতাড়িই।
১১.
বড় চুল রাখলে দলে জায়গা হবে না। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে এমন ফতোয়া দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ পাসারেল্লা, চুল কাটতে রাজি না হওয়ায় বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি সেরা ফর্মে থাকা ফার্নান্দো রেদন্দোর। ২০০২-এ বিয়েলসা নেননি রিকলমেকে। ২০০৬ এ পেকেরম্যান অবাক করা সিদ্ধান্তে বাদ দিলেন জানেত্তি আর স্যামুয়েলকে! কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না তিনি। ২০১০ এ মারাদোনা জায়গা দিলেন না ২০০৯ ইন্টারের ইউসিএল জয়ী দলের দুই কাণ্ডারি জানেত্তি আর ক্যাম্বিয়াসোকে। ২০১৪ এ বাদ গেলেন তেভেজ আর ২০১৮ এ সেরা ফর্মের মাউরো ইকার্দি।
২০১৮ বিশ্বকাপের পরে অন্তবর্তীকালীন প্রশিক্ষক লিওনেল স্ক্যালোনি সমস্ত সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়কেই সুযোগ দিলেন। তাঁর একটাই লক্ষ্য, একটা কোর গ্রুপ তৈরি করা। মেসি জাতীয় দলে না থাকা অবস্থায় একটা দল গড়ে তোলার চেষ্টার শুরু হল তখন থেকেই। উদ্দেশ্য, মেসি নির্ভরতা কমিয়ে ফেলা।
তিনি কি আদৌ আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য? ম্যারাডোনা বললেন, ‘যে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?’ স্ক্যালোনি এসব গায়ে মাখলেন না। মেসি ফিরলে বাকি দলের সঙ্গে তাঁকে সেই সেট আপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় অবিচল থাকলেন। আর্জেন্টিনার সাম্প্রতিক ফুটবল ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম এমন ঘটল। একই সঙ্গে মেসিকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিতে গেলে বাকিদের কতটা খাটতে হবে সেই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা টিমের মধ্যে তৈরি করে দিতে সক্ষম হলেন।
ডি পল, পারেদেস আর জিওভানি লো সেলসো হলেন তাঁর তুরুপের তিন তাস। ধীরে ধীরে তিন বছরের মধ্যে রোমেরো, লিসান্দ্রো, আকুনা, ত্যাগলিয়াফিকো, মলিনা, মনটিয়েল, লতারো, এমি জায়গা করে নিলেন স্কোয়াডে। দলে রইলেন তিন পুরনো ঘোড়া, অধিনায়ক মেসি, ডি মারিয়া আর শেষ বয়সে এসে অনেক পরিণত এবং স্থিতধী ডিফেন্ডিং করা নিকোলাস ওতামেন্দি। প্রচন্ড ওয়ার্ক রেট, কাউন্টার প্রেসিংয়ের ছবি দেখা যেতে লাগল আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের ফুটবলে।
এই কোর গ্রুপে ভরসা করেই ২৮ বছর পরে ট্রফি এল আর্জেন্টিনায়, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ব্রাজিলের মাটিতে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হল লা আলবিসেলেস্তে। তারপরে ইউরো জয়ী ইতালির বিরুদ্ধে ফিনালিসিমা জয়। বিশ্বকাপের আগে এই দলের সঙ্গেই যোগ দেবেন ম্যাক অ্যালিস্টার, এঞ্জোর মত তরুণ খেলোয়াড়রাও। ততদিনে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে ‘লা স্ক্যালোনেতা’।
মহামারী পরবর্তী লকডাউনের পৃথিবীতে বায়োবাবলে পরিবার-প্রিয়জনদের থেকে দূরে থেকে একটা গোটা টুর্নামেন্ট খেলার সময়েই দলের সংহতি মজবুত হয়েছিল। আর অনুপ্রেরণা হিসেবে সবসময়ে ছিলেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি!
১২.
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। বুয়েনোস আইরেস জনস্রোতে ভেসে যাচ্ছে। পাল্লা দিচ্ছে বাংলাদেশ, কেরালা কিংবা পশ্চিমবঙ্গ, অজস্র অলি গলি পাড়ার নিঝুম আলোয় জেগে উঠছে অজস্র মানুষের কোলাহল। ৩৬টা বছর! দীর্ঘ ৩৬ বছর।
লিওনেল মেসির হাতে শোভা পাচ্ছে এতদিনের অধরা মুকুট। আকাশে আতশ বাজি আর মাটিতে জনসমুদ্র। সুদূরে কত কত আবছা বিন্দু মিলে মিশে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে অদৃশ্য সময় সারণী…
লিওনেল, আপনার আইডল পাবলো আইমার কোনওদিন খেলোয়াড় হিসেবে জিততে পারেননি এই ট্রফি। ডাগ আউটে কোচিং স্টাফ হিসেবে বসে তিনি আপনার গোল দেখে কখনও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, কখনও দুহাতে মুখ ঢেকে বিহ্বলতায় হেসে উঠছেন।
বহু হতাশার সাক্ষী রবের্তো আয়ালা এবং ওয়াল্টার স্যামুয়েল আরও একবার প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছেন নিজেদের যৌবনের স্বপ্ন অবশেষে সফল হচ্ছে। তাঁদের শেষ মুহূর্তের সব হেরে যাওয়াকে পার করে এসে নতুন প্রজন্মের ডিফেন্ডার রোমেরো, লিসান্দ্রোরা ম্যাচ জিতে নিচ্ছেন কঠোর মানসিকতাকে সম্বল করে। খেলোয়াড় জীবনের সব অপ্রাপ্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে কোচিংয়ের আঙিনায় এসে। আর হুগো তোকাল্লির ছেলে মার্টিন দেখছেন গোলকিপার এমি মার্টিনেজের জেদি লড়াই, দুর্ধর্ষ সব সেভ, ম্যাচ জেতানো ভরসার হাত।
আর এক লিওনেল কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। সাদামাটা কেরিয়ার, কোচিং জীবনের অনিশ্চয়তা পার হয়ে এসে ২৮ আর ৩৬ বছরের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা মেটানোর কারিগরের কি মনে পড়ছে ২০০৬ এর স্বপ্নভঙ্গের রাত?
গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে গ্যালারিতে ভিড় করে থেকেছেন বাতিস্তুতা, ক্রেস্পো, ক্যাম্বিয়াসো, সোরিন, জানেত্তিরা। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে মেসির ‘টপো জিজো’ উদযাপনে মাঠে যেন নেমে এসেছেন এনগ্যাঞ্চে সম্রাট রিকলমে। ডি পলের খেলায় হয়তো নিজের নাছোড় মনোভাব খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ক্লাবের কোচ দিয়েগো সিমিওনে। আর বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক ‘নতুন মারাদোনা’? রিভারপ্লেটের সদ্য প্রাক্তন কিংবদন্তি কোচ মার্সেলো গালার্দো এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের জন্য উপহার হিসেবে দিয়েছেন দুই প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরুণকে, হুলিয়ান আলভারেজ আর এঞ্জো ফার্নান্দেজ। আবির্ভাবেই বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। আর ফাইনালের জয়সূচক পেনাল্টি মারা গনজালো মন্তিয়েলও যে ২০২১ অবধি তাঁর তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠেছেন দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে!
এ বিশ্বকাপ যে আপনাদেরও বিয়েলসা এবং পেকেরম্যান। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিনগুলোতে আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের দুরবস্থা সত্ত্বেও কখনও বেতন ছাড়া কখনও বা স্বল্প বেতনে কাজ করেও ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেননি। এ বিশ্বকাপ আপনারও আলেহান্দ্রো সাবেল্লা, দীর্ঘ ২৪ বছর পরে আপনিই তো পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বজয়ের একদম কাছে। বড় নীরবেই পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিলেন বছরখানেক আগে!
মাঠেই অঝোরে কাঁদছেন বৃষ্টি, শীত, অন্ধকারের ভয়ঙ্কর দশকগুলো পেরিয়ে আসা ডি মারিয়া। আট বছর আগের ফাইনাল খেলতে না পারার কষ্টের কান্না আজ বদলে গেছে আনন্দাশ্রুতে। অলিম্পিক, কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমার পরে বিশ্বকাপ ফাইনালেও তাঁর গোল লেখা হয়ে গেছে লোকগাথায়।
আর লিও মেসি? ৩৫ বছরের যুবক কি ফিরে যাচ্ছেন রোজারিও, নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ-এর শৈশবের দিনগুলোতে? কৈশোরেই সেই যে দেশান্তরী হলেন আশঙ্কা ছিল হয়তো স্পেন কেড়ে নেবে তাঁকে, কিন্তু মেসি চাইতেন আর্জেন্টিনার জার্সিতেই খেলতে। তোকাল্লি ভিডিও টেপ দেখে ওমার সৌতোকে বলতে তিনি মেসির সঙ্গে কথা বলে আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন। তারপরে শুধুই ইতিহাস।সে ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় যন্ত্রণার, পরাজয়ের, হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার, বেদনার – তাঁর শেষ অধ্যায় ফিরে আসার, জয়ের, স্বীকৃতির। মেসি মারাদোনা হতে পারেননি কিংবা চান নি, তুলনার কক্ষপথ থেকে দূরে সরে যেতে যেতে মেসি হয়ে উঠেছেন স্বতন্ত্র। আজ আগুয়েরোর কাঁধে চড়ে তিনি যখন মাঠ প্রদক্ষিণ করছেন জনস্মৃতিতে ফিরে আসছে মারাদোনার বিশ্বজয়ের রাতের দৃশ্য।
গ্যালারিতে উপস্থিত ১৯৭৮-এর বিশ্বজয়ী নায়ক মারিও কেম্পেসও। গ্যালারিতে নেই শুধু একজন, দিয়েগো মারাদোনা। ২০২০-এর নভেম্বরেই তিনি চিরদিনের মত বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে। যে নির্বুদ্ধিতার খেলাকে কেন্দ্র করে তিনি পৌঁছে গেলেন মানুষের কাছে সেই খেলায় উত্তরসূরীদের বিশ্বজয়ের মুহূর্তে তাঁর অনুপস্থিতি যেন মূর্ত বিষাদ। কিন্তু সত্যিই কি তিনি অনুপস্থিত?
গ্যালারির সমর্থক আর খেলোয়াড়দের কণ্ঠে বেজে উঠছে এক গান। Muchachos, Ahora Nos Volvimos a Ilusionar। সেই গানে রয়েছে নতুন এক স্বপ্নের কথা। আমরা দিয়েগো এবং লিওনেলের দেশের মানুষ, আমরা মালভিনাসে বেড়ে ওঠা ছোট শিশুদের দেশের মানুষ। কতগুলো ফাইনালে আমরা হেরে গেছি, শোকে মুহ্যমান হয়েছি মনে পড়ে? সেসব দিন এখন অতীত। মারাকানায় আমরা ব্রাজিলকে হারিয়েছি। এবার আমরা চাই তৃতীয় বিশ্বকাপ। আমরা দেখতে পাচ্ছি আকাশ থেকে দিয়েগো সমর্থন করছেন লিওকে – এবার আমরা বিশ্ব জয় করতে চাই, আবার আমরা বিশ্বজয়ী হতে চাই।
নির্বুদ্ধিতা যে কোনও যুক্তি মানে না! কেন বছরের পর বছর ট্রফিহীন থাকা একটা দলের বিশ্বব্যাপী সমর্থকেরা প্রতিবার বুক বাঁধে নতুন আশায়? কোন উদ্যমে বাংলাদেশের একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া পেজ, গ্রুপের সদস্যেরা একের পর এক অনুবাদ করে চলেন আর্জেন্টিনার জার্নালিস্টদের টুইট, খেলোয়াড়, কোচেদের প্রেস কনফারেন্সের বিশদ বিবরণ? কোন উন্মাদনায় সুদূর ভারতে কিংবা পাকিস্তানের মানুষ খুঁজে চলেন সম্প্রচারিত না হওয়া আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগের হালহকিকত? কেনই বা এই উদ্বিগ্ন প্রহর গোনা?
তৃতীয় বারের জন্য বিশ্বকাপ এসেছে। অতীতের সব পথ এসে মিশে গেছে ১৮ ডিসেম্বরে। কত না পাওয়া লড়াই, কত অস্বীকৃত অবদান শেষমেশ স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার? এবার কি থেমে যাওয়া? নাকি আরও নতুন রোমাঞ্চের যাত্রায় পাড়ি দিয়ে ‘ভ্যামো ভ্যামো আর্হেন্তিনা’ স্লোগানে পথ মুখরিত করবে নীল সাদা জার্সির মালিকানা নেওয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সমর্থককূল?
অপেক্ষার তো শেষ থাকতে নেই।