অ্যাকশন স্পিকস লাউডার দ্যান ওয়ার্ডস! বহুল-চর্চিত, বহুল-বিশ্লেষিত এই কথা। কিন্তু খুব খুব কম ক্ষেত্রেই এমন অ্যাকশন পাওয়া যায়, যা শব্দের চেয়েও বেশি আস্ফালনে নিজের বক্তব্য রেখে যায়।
এই গ্রুপে বহু-বহু এমন ‘অ্যাকশন’- এর উদাহরণ রাখা হয় অবিশ্যি। ‘টিমের স্বার্থে’ সেঞ্চুরির মুখে স্লো না হওয়া, ‘টিমের স্বার্থে’ দলের ব্যাটসম্যান ডাবল-সেঞ্চুরির মুখে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন ডিক্লারেশন দেওয়া, টিমের স্বার্থে ফর্মে না থাকা প্লেয়ারের সরে দাঁড়ানো – অজস্র, অজস্র বিশ্লেষণ, তথ্য, তালিকা।
সে সব দেখি আর চমৎকৃত হই। ভাল লাগে। কিন্তু স্বভাবে আমি গল্প-লেখক। যা বলা নেই, যা স্পষ্টাক্ষরে ঘোষিত নয়, সেরকম বিবৃতিগুলি খুঁজে পেলে বেশি ভাল লাগে আমার।
সাল ২০১০, তারিখ – ২৪ ফেব্রুয়ারি!
তখনও ভারত ৫০-৫০-এর বিশ্বকাপ জেতেনি, মানে দ্বিতীয়টা জেতেনি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতাও তিন বছর দূরে। ক্যাপ্টেন মহেন্দ্র সিং ধোনি তখন ব্র্যান্ড ঠিকই, কিন্তু আইসিসি টুর্নামেন্টে দেশের শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে নিজের পাকাপাকি সিলমোহর তখনও দেওয়া বাকি তাঁর। বরং তখনও ইতিউতি কান পাতলে শোনা যাচ্ছে সৌরভ, দ্রাবিড়কে ওডিআই টিম থেকে ব্রাত্য করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা – ততদিনে স্তিমিত ঠিকই, কিন্তু একেবারে মুছে যায়নি।
এই রকম পটভূমিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, ক্যাপ্টেন যখন ব্যাট করতে নামছেন, তখন দলের স্কোর ঠিক ৩০০। ওভার? ৪১.১!
হাতে আছে ৫৩টি বল। দলের সেরা ব্যাটার তখন দাঁড়িয়ে আছেন ১৬৮ রানে আর মনে হচ্ছে, কোনও বলই তাঁর ব্যাটের সামনে নিরাপদ নয়। এ সময় যে কোনও নবাগত ব্যাটারের, সে ঘোষপাড়া নেতাজি সংঘের হলেও, একটাই উদ্দেশ্য থাকে – যেভাবে হোক, সেট এবং মারমুখী ব্যাটারকে স্ট্রাইক দেওয়া যাতে দলের স্কোর যতটা সম্ভব এগিয়ে যায়। দলের স্বার্থে!
ধোনিও ঠিক তাই করলেন, প্রথমে!
৪৫-তম ওভারের মধ্যে শচীন পৌঁছে গেছেন ১৯১-এ। ধোনি তখন নেহাতই উচ্চ-মধ্যবিত্ত, ১৩ বলে ১৭।
আরও কিছুক্ষণ পরে, শচীন ১৯৯, ১৪৬ বলে। ধোনি – ২৫ বলে ৩৬।
কিন্তু ঠিক এই সময় নাগাদই ধোনি (এবং শুধু ধোনি নয়, যাঁরা সেদিনের ম্যাচ লাইভ, মন দিয়ে দেখছিলেন তাঁরাও) বুঝতে পারছিলেন, লম্বা ইনিংসের ধকলে শচীন ক্লান্ত। বলের পেস ব্যবহার করে বাউন্ডারি মারতে পারছেন হয়তো, কিন্তু বলের পেস কেড়ে নিলে, শুধু স্ট্রোকের জোরে মাঠ পার করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর পক্ষেও! অতএব নিজের অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়ালেন ঝাড়খণ্ডের রহস্যময়!
পরের বাকি বলগুলিতে যত বেশি সম্ভব স্কোর করতে হবে। ন্যাশনাল-হাইওয়ের মতো চকচকে পিচে আমলা-গিবস-কালিস-ডিভিলিয়ার্স-ডুমিনির সামনে এমন স্কোর খাড়া করতে হবে, যেটা নিরাপদ না হলেও দুরধিগম্য! সেই উদ্দেশ্যের সামনে কারো ব্যক্তিগত মাইলস্টোন বড় হতে পারে না। তিনি স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার হলেও নয়।
অতএব বাকি ১১টি ডেলিভারির মধ্যে পরপর ৮টি বল খেলবেন মিডিয়া-ভক্তকুল-ক্রিকেট পণ্ডিতদের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করা ২৯ বছরের তরুণ। উল্টো দিকে দাঁড়ানো কিংবদন্তিকে প্রায় দাঁড় করিয়ে রেখেই চোখের পলক ফেলার আগে ২৫ বলে ৩৬ থেকে পৌঁছালেন ৩৩ বলে ৬০!
উৎকণ্ঠিত আমাদের চোখে কি ভিলেন হয়ে যাবেন? শচীন কি মুলতানের মতোই বাইরে এসে অসন্তোষে ফেটে পড়বেন? জবাবদিহি চাইবে বিসিসিআই? মুণ্ডু চাইবে রান-রেকর্ড বুভুক্ষু মুম্বই-ক্রিকেট লবি?
এসব প্রশ্নকেও তিনি অবহেলায় বাউন্ডারির বাইরেই পাঠাচ্ছিলেন, ভুল বললাম – অন্তত সেই সময়ের ধোনির জমানায় এসব প্রশ্নের কোনও স্থানই ছিল না মাঠে।
কিন্তু তাও, তৎসত্ত্বেও, ধোনি নির্মম প্রসেস ও একবগ্গা টিমগেমের মধ্যেও জানতেন, খেয়াল রেখেছিলেন, ‘টিম’কে সেই অবস্থায় নিয়ে আসা বিশেষ লোকটির বিশেষ অবদানের কথা। তিনি ভারসাম্যে ভুল করেন না। করলেন না। ১৪৬ বলে ১৯৯ রান করে দাঁড়িয়ে থাকা শচীনকে পঞ্চাশতম ওভারে একটি বলও না দিয়েই তিনি ব্যাট করতে পারতেন। ১৩ বছর বাদে তাঁর প্রশস্তিতে হ্যাজ নামত, তথ্য সমেত।
কিন্তু ধোনি জানেন, তথ্যে নয়, পারফর্মার বেঁচে থাকেন মানুষের স্মৃতিতে। কীভাবে সে বেঁচে থাকতে চায়, তা তাকেই স্থির করতে হবে! তিনি জানেন, কতটুকু করা যায়, বিশেষ লোকটির বিশেষ অবদানের কথা মনে রেখে কতটুকু বিশেষ ট্রিটমেন্ট দেওয়া যায়!
তাই, পঞ্চাশতম ওভারের চতুর্থ বলটিতে স্ট্রাইক পেলেন ১৯৯-এ দাঁড়ানো শচীন। সিঙ্গল নিয়ে ২০০ রান পূর্ণ করলেন তর্কাতীতভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ওয়ানডে ওপেনার।
পরের দুটি বল? ধোনি মারলেন আরও দুটি বাউন্ডারি! দল পৌঁছল ৪০১ রানে। ভারত ম্যাচ জিতল হাসতে-হাসতে, একতরফা!
ধোনি নিজে যা করতে পারতেন না, তা কাউকে করতে বলতেন না। কর্পোরেটে না থেকেও হয়তো জানতেন, ‘walk the talk’-এর বিকল্প নেই। তাই নিজের বা অন্য কারো রেকর্ডের পরোয়া না করে টিমকে এগিয়ে রাখতে বলার জন্য তিনি ড্রেসিংরুমে বসে ডিক্লারেশন নয়, মাঠে নেমে কাজটা করে দেখাতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ওডিআই ক্রিকেটের তেনজিং প্রথমবার এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন। এক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা শেরপাটিকে আমরা উচিত কারণেই মনে রেখেছি; টিমকে জেতাতে গিয়ে তাঁকে টিমম্যানের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়নি।
His action spoke louder than words. Alas! Some of us were too blind to see that, too deaf to hear that!
পুনশ্চ, এইটুকু না বললে, অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আপনি কিন্তু ২০০ করার জন্য যথেষ্ট স্ট্রাইক পাননি – এই প্ররোচনামূলক মন্তব্যটি প্রশ্নের আকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল “স্বার্থপর”, “খুঁটে-খুঁটে-রান-করা” বৃদ্ধের কাছে। তাঁর জবাব?
শচীন বলেছিলেন, ‘We were so focussed in the match that we did not realise at that moment. But when I came out my friends said I got less strike. I said how does it matter? It does not matter how runs are made. If I am not wrong I got the second last ball in the last over and I think I was on 199. I got a yorker outside off which I played towards point and there was a mis-fielding as well. Anyway, we took off for a run which you would do in the last over. No, but I did not feel I got less strike.’