শিভাম দুবে, শূন্য থেকে সাগর হওয়ার নামই জীবন

চার বছর ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন। ফেরার পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বয়স ২৪ পেরোনোর পর। পেশাদার ক্রিকেটে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না শিভাম দুবের। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, ধবংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক রূপকথার গল্প লিখেছেন। জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, আইপিএলেও চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সিতে লিখে চলেছেন ফিনিক্স পাখির ন্যায় উত্থানের এক গল্প। 

মুম্বাইয়ের শিভাম দুবের গল্পের পুরোটা জুড়েই থাকবেন তাঁর বাবা রাজেশ দুবে। রাজেশ নিজে কুস্তিগীর ছিলেন, খেলাধুলাকে জীবনের অংশ নয় বরং দেখেন জীবন হিসেবেই। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকেই সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। 

শিভামের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখনই ছেলের ক্যারিয়ারের প্রতি মনোযোগ দিতে নিজের ব্যবসার ইতি টানেন রাজেশ। ছেলেকে প্র্যাকটিসে নিয়ে যাওয়া, প্রতিটি ম্যাচে মাঠে থাকা থেকে শুরু করে বাড়ির পেছনে আলাদা পিচ তৈরি করেন যাতে ছেলের অনুশীলনে বাঁধা না পড়ে। মোদ্দাকথা, ছেলের জন্য নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেন রাজেশ দুবে। 

শিভামের উন্নতির গ্রাফটাও ছিল দারুণ। স্থানীয় ক্রিকেটে ছক্কা হাঁকানোর সুনামের পাশাপাশি মাঝের ওভারে তাঁর মিডিয়াম পেস বোলিংও ছিল দারুণ কার্যকরী। কিন্তু কৈশোর পেরোনোর আগেই দারুণ অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হয় দুবে পরিবার। ক্রিকেট ছেড়ে দেন শিভাম, ১৩ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত ক্রিকেট মাঠে যাবার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর।

রাজেশের ভাষায়, ‘আমি সেই সময়টাতে খুবই হতাশ ছিলাম। বড় অংকের ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলাম, বাসায় সারাদিন কান্নাকাটি করতাম। আমার পরিবার পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং শিভামের ক্রিকেট পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল।’

পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার প্রথম ধাপে এমন ধাক্কা খাওয়ার পর যে কেউই চাইবেন ভিন্ন পেশা বেছে নিতে। কিন্তু শিভাম সে পথে হাঁটেননি, চার বছর বাদে যখন তাঁর পরিবার সবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিলেন বাইশ গজে ফেরার। তিনি জানতেন সামনের পথটা বড়ই বন্ধুর, কিন্তু বাবার সাহচর্যে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন। 

ক্রিকেটে ফেরার প্রথম ধাপেই সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ফিটনেস। দীর্ঘদিন খেলার বাইরে থাকার সুবাদে শিভামের ওজন গিয়ে ঠেকেছিল ১১০ কেজিতে। কিন্তু বাবার অধীনে কঠোর পরিশ্রম শুরু করলেন তিনি, ঘন্টার পর ঘন্টা মাঠে দৌঁড়াতেন। এক বছরের মাঝে ওজন কমে দাঁড়ায় ৭৫ কেজিতে। 

কিন্তু মুম্বাইয়ের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট পাড়ায় চার বছর বাদে ফেরাটা মোটেই সহজ ছিল না। বিশেষ করে একাডেমি গুলোতে শিভাম মোটেই সুযোগ পাচ্ছিলেন না, দেখা যেত গোটা সপ্তাহে মাত্র এক ঘন্টা নেটে ব্যাট করতে পেরেছেন তিনি। তাই কঠিন এক সিদ্ধান্তে আসেন শিভাম এবং রাজেশ, ছেড়ে দেন একাডেমি। শুরু করেন বাড়িতেই অনুশীলন, রাজেশ সারাদিনে হাজারবার বল ছুঁড়তেন আর ছেলে ব্যাট করতেন। 

শীঘ্রই হার্ড হিটার ব্যাটসম্যান হিসেবে মুম্বাইয়ের ক্রিকেট পাড়ায় নাম ছড়িয়ে পড়ে শিভামের। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজের প্রথম মৌসুমেই দারুণ পারফর্ম করে জায়গা করে নেন মুম্বাইয়ের রঞ্জি ট্রফির স্কোয়াডে। অভিষেক ম্যাচেই পাঁচ উইকেট শিকারের পাশাপাশি মৌসুম শেষ করেন ২৩ উইকেট এবং ৬৩২ রান নিয়ে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। 

২০১৯ আইপিএল নিলামের ঠিক আগের দিন রঞ্জি ট্রফিতে বরোদার বিপক্ষে এক ওভারে পাঁচ ছক্কা হাঁকিয়ে আলোচনায় আসেন শিভাম দুবে। সেই সুবাদেই কিনা পাঁচ কোটি রুপির বিনিময়ে তাঁকে দলে ভেড়ায় রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। কিন্তু নিজের প্রথম মৌসুমটা মোটেই স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি, ফলে দুই মৌসুম বাদেই তাঁকে ছেড়ে দেয় দলটি। এরপর রাজস্থান রয়্যালসের হয়েও মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেননি। মাঝে অবশ্য ঘরোয়া ক্রিকেট এবং এ দলের হয়ে পারফর্ম করে জাতীয় দলেও ডাক পান। কিন্তু থিতু হতে পারেননি। 

২০২২ মৌসুমে শিভামকে দলে ভেড়ায় মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস। চেন্নাইয়ের হয়েই নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেন এই তারকা, প্রথম মৌসুমেই উপহার দেন দারুণ কিছু বিধ্বংসী ইনিংস। গত মৌসুমের ফর্মটা টেনে এনেছেন এবারের আসরেও, মিডল অর্ডারে নেমে প্রায় প্রতি ম্যাচেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলছেন। নিজের সাবেক দল ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষেই খেলেছেন ২৭ বলে ৫২ রানের মারকুটে এক ইনিংস, যেখানে দুই চারের বিনিময়ে ছক্কা হাঁকিয়েছেন পাঁচটি। 

জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ১৩ ম্যাচে মাঠে নামার সৌভাগ্য হয়েছে দুবের। বছর পেরোলেই মার্কিন মুলূকে বসবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর। গুঞ্জন আছে তারুণ্যনির্ভর এক দল নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে যাবে ভারত। শিভাম দুবে তাই চাইবেন আইপিএলের ফর্মটা ধরে রেখে ভারতের সেই স্কোয়াডের অংশ হতে। তবেই না পূরণ হবে রাজেশ দুরের সেদিনের স্বপ্নটা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link