বেঁচে থাকো, টেস্ট ক্রিকেট

ফ্লাড লাইটের নিচে রঙিন পোশাক আর সাদা বলের ঝলকানি, চিয়ার লিডারদের উদ্দাম নৃত্য, গ্যালারি ভর্তি দর্শক।

ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টির এমন যুগে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে অনেক প্রশ্ন। এত্ত সময় ধরে কি খেলে! ৫ দিন! এই ক্রিকেট কী এখন আর চলে?

চলে, চলে। এই যে দেখেন না, চোখের সামনে একটা পর একটা টেস্ট পাঁচটা দিন ধরে কী রোমাঞ্চ দেখাচ্ছে। শেষ সিডনি টেস্টে চললো এই রংয়ের খেলা।

টেস্ট ক্রিকেটকে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়ার মতো সব কাণ্ড করা হয়েছে। কাইরন পোলার্ড, লাসিথ মালিঙ্গাদের মতন প্রতিভারা এই যুগে টেস্ট ক্রিকেট খেলতে অনীহা দেখান। স্পন্সর-মিডিয়ার আগ্রহ সেই টি-টোয়েন্টি লিগে। টেস্ট ক্রিকেটের অলসদের খেলা! সে নাকি অলসদের খেলা!

আইসিসিতে আলোচনা ওঠে ৫ দিনের জায়গায় ৪ দিন করা যায় কিনা?

কিন্তু, ক্রিকেট এসব আলোচনা সইবে কেন? তার নিজের যে শ্রেষ্ঠতম রূপ সেই টেস্ট ক্রিকেট। সেরা ফয়সালাটা যে হয় এই সাদা পোশাক আর লাল বলের ৫ দিনের ম্যারাথন লড়াইয়ে? তাই বুঝি টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচাতে ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এই ফরম্যাটেই পারদর্শিতা দেখানো বাধ্যতামূলক!

সবাই যখন নাক কুঁচকে এর ওপর থেকে মন সরিয়ে নিতে চায় তখনই টেস্টক্রিকেট হাজির হয় নিজের সেরা উপহারগুলো নিয়ে!

টেস্ট ক্রিকেটের মাহাত্ম বোঝাতে হাজির হয়ে যান রাহুল দ্রাবিড়-ভিভিএস লক্ষ্মণ ইডেন গার্ডেনস কি অ্যাডিলেডে। সেরা ফর্মের লি-ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রাদের সামলে জন্ম দেন রূপকথার। অ্যান্টিগায় ছবি এঁকে চলেন রামনরেশ সারওয়ান-শিবনারায়ন চন্দরপল। মোহালিতে কুম্বলে-হরভজনদের ছোবল এড়িয়ে অপূর্ব ইতিহাস রচেন আব্দুল রাজ্জাক-কামরান আকমল!

টেস্ট ক্রিকেট! আহ!  টেস্ট ক্রিকেট!

১০০ স্ট্রাইকরেটের এবি ডি ভিলিয়ার্সও তাঁর জন্য দিল্লির গরমে উপহার নিয়ে আসেন ২৯৭ বলে ৪৩ রানের ইনিংস! পেস বোলারের স্বর্গ ওয়াকায় অজি গতি সামলে চেজ করেন ৪১৩ রান। একজন নিল ওয়াগনার ভাঙা আঙুল নিয়ে বল করে যান ২১ ওভার! আবার একজন গ্রায়েম স্মিথ ভাঙা হাত নিয়ে দল বাঁচাতে নেমে যান মিচেল জনসনের ১৫০ কি.মি গতির সামনে! কিংবা একজন অনিল কুম্বলে যেমন ভাঙা চোয়ালে দাঁড়িয়ে পড়েন ব্রায়ান লারাকে রুখতে!

কখনো ট্রেন্টব্রিজে ব্রড-অ্যান্ডারসনের সুইংয়ের সামনে দশ নম্বর ব্যাটসম্যান অ্যাস্টন অ্যাগারকে নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়ে যান ফিলিপ হিউজ। ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিনতম উইকেটের একটি ডারবান,সেই ডারবানে সিংহ সেনাপতি কুশল পেরেরা হুংকার দেন ফিলান্ডারের সুইং-রাবাদার গতির সামনে। জানিয়ে দেন লংকান ক্রিকেট মরেনি। জ্যাক লিচকে সাথে নিয়ে হেডিংলিতে শেষ উইকেটে অমরগাঁথা রচনা করেন বেন স্টোকস! ক্যারিবিয়ান নস্টালজিয়া ফিরিয়ে এনে শেই হোপ-ক্রেইগ ব্র‍্যাথওয়েটরা ইংলিশ সুইং পরাস্ত করে অসম্ভব সম্ভব করেন!

আর এসব দেখে আমরা মুগ্ধ হই। ৫ দিনের মাটি কামড়ে ধরা লড়াই!

২০১৯ সাল শেষ হলো নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তানের চমৎকার বক্সিং ডে টেস্ট দিয়ে। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে সেই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড জিতেছিলো। কিন্তু ফাওয়াদ আলম, মোহাম্মদ রিজওয়ানরা স্নায়ু উত্তেজনা বাড়িয়েছিলেন। একদম পঞ্চম দিনের শেষ সেশন পর্যন্ত লড়াই। আর এই বছর নিউ ইয়ার টেস্টে ভারত-অস্ট্রেলিয়া দেখালো আরও এক ক্ল্যাসিক। চেতেশ্বর পূজারা, ঋষভ পান্থ’র অমন দুটি ইনিংসে জয় জয় গন্ধ পাওয়া ভারতকে শেষ পর্যন্ত হারের খাদ থেকে হনুমা বিহারী-রবিচন্দ্রন অশ্বিন যেভাবে বাঁচালেন স্রেফ অবিশ্বাস্য ঘটনা যেনো! অজি বোলারদের ওই আগুনে বোলিংয়ের সামনে অশ্বিন-বিহারীর ডিফেন্স ইতিহাস হয়ে গেলো!

এই টেস্টেই আমরা দেখলাম অশ্বিনের মায়াজাল ভেদ করলেন স্টিভ স্মিথ! প্রথম দুই ম্যাচের ব্যর্থতা ঢেকে ১৩১ আর ৮১!

এই টেস্ট ফিরে ফিরে আসুক। এই টেস্ট বেঁচে থাকুক। টেস্টের এই পাঁচ দিনের রোমাঞ্চ এমন করেই টিকে থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link