এ কালের মিস্টার ক্রিকেট

জাস্টিন ল্যাঙ্গার তখন সবে অস্ট্রেলিয়ার কোচ হয়েছেন।

দলকে একটু পরামর্শ দেওয়ার জন্য নিজের সাবেক সতীর্থ স্টিভ ওয়াহকে ডেকে এনেছেন অনুশীলনে। স্টিভ সবার সাথে কথা বলেছেন, টিপস দিয়েছেন। তারপর ল্যাঙ্গারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই, তোমার সেই ছেলেটা কই?’

ল্যাঙ্গার ছেলেটাকে সামনে ঠেলে দিলেন। স্টিভ ওয়াহ বললেন, ‘তুমি নাকি সবসময় ক্রিকেট নিয়েই কথা বলো?’

ছেলেটি লাজুক হেসে বললো, ‘আপনার সাথে ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।’

এই হলো মার্নাস লাবুশেন!

ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার একটি সেকেন্ডের সুযোগও তিনি নষ্ট করতে চান না। তার কাছে আড্ডা মানে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলা, ঘুম মানে ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখা এবং বাকীটা সময় ক্রিকেট খেলা। তিনি এ কালের মিস্টার ক্রিকেট।

আজ আবার একটা সেঞ্চুরি করে অস্ট্রেলিয়াকে অপ্রত্যাশিত বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। এটা লাবুশেনের পঞ্চম সেঞ্চুরি। এই নিয়ে ১৮৬০ রান করলেন তিনি ক্যারিয়ারে; ১৫ বার পঞ্চাশ পার করা ইনিংস খেলেছেন। ২০১৮ সালে লাবুশেনের অভিষেকের পর থেকে তার চেয়ে বেশী রান, তার থেকে বেশী পঞ্চাশ পার করা ইনিংস আর কেউ খেলতে পারেননি।

লাবুশেনকে নিয়ে কথা বলার বিপদ হলো, ঠিক কোথা থেকে শুরু করা যাবে।

তিনি ঠিক অস্ট্রেলিয়ান ছিলেন না; তারপরও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিংয়ের প্রতিশব্দ। তিনি ঠিক টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন না; তারপরও বিশ্বের সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। তিনি ঠিক স্টিভেন স্মিথ নন; তারপরও তাকে লোকে স্মিথের ক্লোন বলছে!

তাহলে কোনটা আগে বলবো?

আগে বরং তার নাম দিয়ে শুরু করা যাক। ইংরেজীতে নাম নামটা হলো Labuschagne। অনেক কষ্ট করে আপনি এটাকে ‘লাবুসচেঞ্জ’ বলে উচ্চারণ করতে পারেন। এমন জটিল উচ্চারণ লোকেরা করতে পারছিলো না। তাই একেক জন একেক রকম উচ্চারণ করছিলো। এই জটিলতা মেটাতে তিনি নিজে এক ইউটিউব ভিডিও নিয়ে হাজির হলেন। সেখানে লোকেদের বুঝিয়ে বললেন, তার নাম আসলে-লাবুশেন!

নামের মতো তার পরিচয় নিয়েও বিভ্রাট আছে।

লাবুশেনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকায়। ক্লার্কসড্রপ বলে একটা শহরে জন্মেছেন তিনি আফ্রিকান বাবা-মায়ের ঘরে। কোনো শেকড় টেকড়ের টানে নয়, ভাগ্যের সন্ধ্যানে অস্ট্রেলিয়ায় চলে এসেছিলো লাবুশেন পরিবার। এখানে লাবুশেন ক্রিকেট শুরু করলেন।

সমস্যা হলো, তিনি ইংরেজী বলতে পারতেন না। ফলে সতীর্থদের সাথে যোগাযোগ কষ্ট হতো। অবশ্য সেটা সামলে নিলেন; কারন তিনি ক্রিকেট ভাষাটা তো জানতেন।

ক্রিকেটের সবগুলো ভাষাই জানেন শুরু থেকে।

খুব ভালো ফিল্ডার, ভালো লেগস্পিনার এবং একটু ব্যাটিং পারে। মানে, লেগস্পিনিং অলরাউন্ডার। ঠিক ধরেছেন, স্টিভেন স্মিথের মতোই। লোকে জানতো একটু ব্যাটিং পারেন। কিন্তু স্বীকৃত ক্রিকেটে এসে দেখা গেলো, লাবুশেন আসলে ব্যাটিংটাই সবচেয়ে ভালো পারেন।

তবে লোকেরা তাকে প্রথম চিনেছিলো ফিল্ডিংয়ের জন্য।

২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট দলের স্কোয়াডে ছিলেন। বদলী ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নেমে বরুন অ্যারনের দূরন্ত এক ক্যাচ ধরে আলোচনায় আসেন। লোকেরা তার নাম জানতে পারে।

এই বদলী হিসেবে আলোচনায় আসাটা লাবুশেনের ভাগ্য হয়ে গেলো।

২০১৮ সালে টেস্ট অভিষেক হলো। ব্যাটে প্রথম কয়েকটা ম্যাচ যাচ্ছেতাই কাটলো। অবশ্য পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই সিরিজে ৭ উইকেট নিয়ে নিজের পুরোনো পরিচয়টা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্সে সিরিজে ৮১ রানের একটা ইনিংস খেলেছিলেন। তারপরও অস্ট্রেলিয়া দলের তিন নম্বর হওয়ার মতো কিছু দেখাতে পারছিলেন না। সেটা দেখালেন ওই বদলী হিসেবেই।

স্মিথের বদলী!

সর্বশেষ অ্যাশেজে লর্ডস টেস্টে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেলেন স্টিভেন স্মিথ। তার কিছুদিন আগে আইসিসি আইন করেছে, মাথায় আঘাত লাগলে কোনো খেলোয়াড়ের ‘লাইক টু লাইক’ বদলী নেওয়া ‍যাবে। তো স্মিথের ‘লাইক টু লাইক’ লাবুশেনের চেয়ে ভালো আর কে আছে!

লাবুশেন পৃথিবীর প্রথম কনকাশন বদলী হিসেবে মাঠে নামলেন এবং ৫৯ রানের ইনিংস খেললেন। পরের তিনটি ইনিংস ছিলো ৭৪, ৮০ ও ৬৭। ব্যাস, জায়গা পাকা করে ফেললেন লাবুশেন। সেই স্মিথকেই ঠেলে চার নম্বরে পাঠিয়ে দিলেন।

পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিও পেলেন। বছর শেষে দেখা গেলো, সেই স্মিথকেই হারিয়ে লাবুশেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়ে গেছেন।

মানে, লাবুশেন আর স্মিথ; এ ফেয়ারি টেল।

ও, আচ্ছা। এই গল্পটাই তো বলা হয়নি। লাবুশেনকে কেনো লোকেরা নতুন স্মিথ বলে ডাকে?

লাবুশেনের ব্যাটিং তো ঠিক স্মিথের মতো নয়। কিছু আনঅর্থোডক্স ব্যাপার লাবুশেনের মধ্যেও আছে। কিন্তু স্মিথের মতো ঠিক নন তিনি। তারপরও লোকে বলছে, এই ছেলে নতুন স্মিথ। সেটা কী শুধু দু জনই রানমেশিন বলে?

না, এখানে আরেকটু গল্প আছে।

সেটা শুনতে হবে জাস্টিন ল্যাঙ্গারের কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘ওরা দু জন হলো প্রেমিক প্রেমিকার মতো। যতক্ষন জেগে থাকে, একসাথে ফিসফিস করে কথা বলে। একসাথে নাস্তা করে, একসাথে লাঞ্চ করে, একসাথে ডিনার করে এবং একসাথে বেড়াতে যায়। আর সবসময় কথা বলে। কি নিয়ে? ক্রিকেট নিয়ে কথা বলে!’

হ্যা, লাবুশেন আর স্মিথকে আলাদা খুব একটা দেখা যায় না। তারা সবসময় একসাথে থাকেন। এবং ক্রিকেট টেকনিক, ক্রিকেট ইতিহাস, ব্যাটিং, বোলিং; এসব নিয়ে গল্প করতে থাকেন। তারা ক্রিকেট নিয়ে কৌতুক করেন, ক্রিকেট নিয়ে দুঃখের আলাপ করেন। আর এসব আলাপ কে শুরু করেন?

আবার কে! মার্নাস লাবুশেন।

সাধে কী আর তাকে এ কালের মিস্টার ক্রিকেট বলেছি? মাইক হাসি নিশ্চয়ই রাগ করবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link