১.
নয় বছর আগে ৩টে বিশ্বকাপ জিতে ওঠা এক ভদ্রলোক তার চেয়ে অনেক ছোট একটা ১৯ বছরের ছেলেকে ভিডিও দেখে খেলার ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন। ভালবেসে, নিজে থেকে। আর তার ১১ বছর পরে তারা জড়িয়ে পড়ছেন উদ্বেগজনক উত্তেজক কথার চালাচালি-তে, যার শুরু আর শেষ এখন অপ্রাসঙ্গিক। এরপর তাদের সম্পর্ক চলে যাচ্ছে ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে’। কারণ, ছেলেটা তারপর বাড়তে বাড়তে, বড় হতে হতে একটা বিশ্বকাপ জিতেছে অবিসংবাদিভাবে।ব্যাপ্তিতে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে প্রথম ভদ্রলোককে।
ফুটবল এজন্যই বাস্তব জীবন। প্রতিটি ফুটবল কাহিনী ও জীবনীও। কোন রূপকথা নয়।
২.
ছেলেটার মধ্যে নিজের লড়াই খুঁজে পেত কলকাতা। ১৯৮২-র বিশ্বকাপ দেখে সেই যে ডিয়েগো ম্যারাডোনার প্রেমে পড়ে যায় কলকাতা, তা আর কোনদিন হারিয়ে যায়নি৷ তারপর চার বছর পরে পরে বিশ্বকাপ এলেই কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছিল মারাদোনার ছবি সাজিয়ে তাতে ফুল-মালা দেওয়ার রেওয়াজ।
রাস্তায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত আর্জেন্টিনার নীল-সাদা পতাকা। তৈরি করা হত সাদা-নীল তোরণ। দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলত, আঁকা হত মারাদোনার ছবি৷ প্রত্যেক ভক্তের পিঠে থাকত ১০ আর কালো হরফে ‘ম্যারাডোনা’ লেখা জার্সি। তাঁর আগে ব্রাজিলে ডুবে থাকা কলকাতাকে ‘আর্জেন্টিনা’ চিনিয়েছিলেন ম্যারাডোনাই।
ম্যারাডোনা যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন তাঁর জন্য একটি বাস বিশেষভাবে সাজানো হয়েছিল ৷ গোটা বাসের গা জুড়ে ছিল তাঁরই নানান সময়ের ছবি৷ ওই বাসে চড়েই হোটেল থেকে যুবভারতী গিয়েছিলেন তিনি৷ তিনি চলে যাওয়ার পর বাসটিকে রুটের আর পাঁচটি বাসের সঙ্গে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
দশ নম্বর জার্সি লকারে তুলে রাখা বহু ভক্ত অপেক্ষা করে থাকতেন কেবল ওই বাসটির জন্য৷ বাসের হ্যান্ডেল ছুঁয়েও শিহরিত হয়েছেন তাঁরা, কারণ মারাদোনার স্পর্শ লেগে ছিল তাতে।এই মারাদোনাকে দেবতা মেনে পুজো করত কলকাতার ফুটবলে পাগল জনতা। যখন থেকে টিভি এসেছে আর বিশ্বকাপ ফুটবল ঘরে ঢুকে পড়েছে, তবে থেকেই মারাদোনার অপেক্ষায় রাত জেগেছে কলকাতা।
৩.
২০০৫য়ে বিশ্ব ফুটবলের আর এক প্রতিভা জর্জ বেস্ট আর ২০২০তে বিশ্ব ফুটবলের অবিসংবাদী উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মারাদোনাও না ফেরার দেশে চলে গেছেন একই তারিখে। জিনিয়াস জর্জ বেস্টের মৃত্যু আর প্রবাদ মারাদোনার মৃত্যু কোন এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছিলেন ফুটবল বিধাতা। দুটি ঘটনারই তারিখ ছিল ২৫ নভেম্বর, ১৫ বছর আগে আর পরে। ২০০৫য়ের ২৫ নভেম্বর আর ২০২০র ২৫ নভেম্বর। বিশ্ব ফুটবল ইতিহাসের একটা কালো রঙের দিন হয়েই থেকে গেছে ২৫ নভেম্বর তারিখটা।
তাঁর আত্মজীবনীতে যে ১০০ জন ফুটবলারের কথা বলা আছে, তার মধ্যে অবধারিতভাবে আছেন জর্জ বেস্ট। মাত্র এক লাইনে তাঁকে বর্ণনা করেছিলেন ম্যারাডোনা ‘এ গ্রেট প্লেয়ার বাট ক্রেজিয়ার দ্যান মি।’ দু’জনের মধ্যে মাঠ ও মাঠের বাইরে কে বেশি ক্রেজিয়ার, এ নিয়ে অনন্তলোকে এখন নিশ্চয়ই জোর লড়াই হয়।
৪.
ফুটবল তো একটা খেলাই মাত্র।কিন্তু একজন ছিলেন, যিনি ফুটবলকে খেলা নয়, ‘হাতিয়ার’ ভাবতেন, লড়াইয়ের।মাঠে তার ফুটবলের সমান্তরাল আর একটা লড়াই তিনি আজীবন চালিয়ে গিয়েছিলেন, মাঠের বাইরে। সেই লড়াই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল কিউবায় চিকিৎসা করাতে যেতে, ফিদেল কাস্ত্রোর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরতে। সেই লড়াই তার বিবেককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহচর্য নিতে বারণ করেছিল।
সেই লড়াই তাকে শিখিয়েছিল হুগো শ্যাভেজকে শ্রদ্ধা জানাতে। সেই লড়াই তাঁর হাতে এঁকে দিয়েছিল চে গুয়েভারার উল্কি।সেই লড়াই তাকে শিখিয়েছিল করোনা অতিমারির সময়ে নিজের ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের জার্সি দান করে দিয়ে অতিমারির বিরুদ্ধে জনতার পাশে দাঁড়াতে।সেই লড়াই তাকে সাত বছর খেলিয়ে নেয় দুর্বল নেপোলির হয়ে, তাদের নতুন উচ্চতায় তুলে দিতে।
৫.
‘হ্যান্ড অফ গড’ গোলের পাশেই তিনি রেখে গেছেন ঠিক তার কয়েক মিনিট পরের অনন্ত ড্রিবলিংয়ের কোটিং দেওয়া ‘শতাব্দীর সেরা গোলের কেকটিকে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতার কৃতিত্বের পাশেই তিনি রেখে গেছেন ড্রাগ বিতর্ক। ঠিক সে ভাবেই তার ফুটবলের পাশেই তিনি রেখে গেছেন মাঠের বাইরের সমান্তরাল লড়াইটাও। তিনি শুধু ফুটবলার ছিলেন না। ছিলেন দুর্বল, লড়াকু মেহনতী মানুষের বন্ধু ও হাতিয়ার। যতদিন এই পৃথিবীতে ফুটবল থাকবে, তিনি বেঁচে থাকবেন এই পৃথিবীতে।
৬.
যতদিন এই পৃথিবীতে লড়াকু মেহনতী মানুষ থাকবে, তিনি বেঁচে থাকবেন এই পৃথিবীতে। দুনিয়ার সাধারণ মানুষের হয়ে তাঁর সেই অনন্ত ড্রিবলিং আজও চলছে, চলছে আর চলছেই।