মার্চ, ২০১৮। নিউল্যান্ডস, কেপ টাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা!
স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা একটা বড়সড় স্কোরের দিকেই যাচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়াও ছিল বিষম চাপে। এর আগে ঘরের মাঠে তারা এই দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেই সিরিজ হেরেছে। এই ম্যাচ যেদিকে যাচ্ছে তাতে এতেও পরাজয় মনে হয় সুনিশ্চিত। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এমনিতেই বেশ বেগ পেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার, সেবার আরো যেন সবকিছু বেশি করে কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
ম্যাচে চাপ ছিল। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেল। দলের তরুণ এক ওপেনারকে তিনি তখন যেটা করতে বললেন সেটা সোজা ভাষায় বললে হয় – প্রতারণা! স্যান্ডপেপার কাণ্ডের পরের ঘটনা সবাই জানে। ক্রিকেটের এই নিকৃষ্টতম কাজটি করতে তাদেরকে সরাসরি টেলিভিশনেই দেখা যায়। দিনের শেষে অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ক্যামেরন ব্যানক্রফটের দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। বলেন, এ সিদ্ধান্ত ছিল দলের ‘লিডারশিপ গ্রুপ’-এর!
তা স্টিভ স্মিথের লিডারশিপ গ্রুপে যে তিনি আর ডেভিড ওয়ার্নার ছাড়া কেউ ছিল না সেটা তো পরে প্রমাণিতই। এমনকি নিজের বোলারকেও তিনি বল টেম্পারিংয়ের ব্যাপারে জানাননি। আর সত্যি বলতে, বল টেম্পারিং করা হলে বোলার সেটা বল হাতে নিয়েই টের পান না!
- বল-টেম্পারিংয়ের পর
বল টেম্পারিংয়ের পর অধিনায়ক আর সহ-অধিনায়ককে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। স্মিথ আর ওয়ার্নারও সেই দায় মাথায় নিয়ে সরে গেছেন দল থেকে। কিন্তু, বেলা পড়ে এল, দুই তারকার বিদায় হল, অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুমেও কি একটা পরিবর্তন এল না? সংস্কৃতির পরিবর্তন? মানসিকতার পরিবর্তন?
নাকি অন্য কিছু?
- সিডনি, ২০২১
জানুয়ারি, ২০১৮ থেকে আমরা বরং এখন একটু তিন বছর লাফ দিয়ে ফেলি। নিউল্যান্ড ছেড়ে এবার গন্তব্য সিডনি। মাঠে বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন অধিনায়ক টিম পেইন। তা অস্ট্রেলিয়া মাঠে আক্রমণাত্মক হবে এটাই তো ছিল ক্রিকেটের সত্যিকারের রঙ। কিন্তু, টিম পেইন তাঁর আক্রমণাত্মক ভঙ্গির জন্যে পরে ক্ষমা চাইলেন। পাবলিক-স্টেটমেন্টে তিনি বললেন, ‘ম্যাচের চাপ আমি নিজের ওপর নিয়ে নিয়েছিলাম।’
ইংল্যান্ডের দিকে তাকানো যাক। এমন ‘মাটির মানুষ’ তো আসলে তারাই। নিজেদের একটা ভাল ‘ইমেজ’ তারা বিশ্ববাসীদের সামনে সবসময় দেখাতে চায়। মাঠে তারা ভুল করে, সেই ভুল বুঝতে পারে, ক্ষমা চায়, তাদের ক্ষমা করেও দেওয়া হয়।
একেবারে টিম পেইনের মত না?
- পরিবর্তন?
অস্ট্রেলিয়া দলের ‘সংস্কৃতির-পরিবর্তন’ এর কথা বলছিলাম। বল টেম্পারিং কান্ডের পর অধিনায়ক বরখাস্ত হল, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া অফিসেরও এরপর বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। হারিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের চিরাচরিত সৌন্দর্য- স্লেজিং, আরেকটু ভাল করে বললে ইনটেনসিভ স্লেজিং!
এর আগে কি হত? কি ছিল অস্ট্রেলিয়ার মূল কথা? তারা তো এটাই ভাবত যে খেলাটা জেতার জন্যে খেলতে হবে আর এখানে ‘একটু আধটু’ স্লেজিং থাকবে, সেটাই নাকি ক্রিকেটের সৌন্দর্য। এখনকার যারা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের অনুসারী হয়েছেন তারা রিকি পন্টিং এর স্লিপে দাঁড়িয়ে বাক্যবাণ শুনে, সাইমন্ডসের আক্রমণ দেখেই হয়েছেন, তাইনা?
তো সিডনিতে টিম পেইন যখন রবীচন্দ্রন অশ্বিনকে স্লেজিং করলেন, স্ট্যাম্প মাইকে সেটা শোনা গেল। খুব স্বাভাবিকভাবেই টিম পেইনের মাথায় ব্যাগি গ্রিন দেখে এই স্লেজিংয়ে কেউ অবাক হয়নি। ম্যাচের উত্তপ্ত মূহুর্তে এসব তো হতেই পারে। অন্তত অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের কাছ থেকে এসব আসা তো খুব স্বাভাবিকই।
কিন্তু তখনই দ্বিধায় পড়ে যেতে হয় যখন এই একই অধিনায়ককে নিয়ে কোচ জাস্টিন ল্যাংগার বলেন, সে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুমে ভিন্ন সংস্কৃতি এনেছে। সেই সংস্কৃতি কি? এই আক্রমণ? সেটা তো বাপু আগেই ছিল!
তবে টিম পেইন কিন্তু এসব সেদিনই প্রথম করেননি। এর আগেও ভারতের সাথে সিরিজে তিনি ঋষভ পান্তকে নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। ‘বেবিসিট’ কাণ্ড সবাই জানে, সেজন্যে আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন হচ্ছে না। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক যে সেদিন সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে আসা কাউকে নিয়ে এভাবে স্লেজিং করলেন,
এটা কি কোনভাবেই সংস্কৃতির পরিবর্তনের আভাস দেয়?
- ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া-খেলোয়াড়-ভাবমূর্তি
অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিং রুমে সত্যিকার অর্থেই ‘সংস্কৃতির পরিবর্তন’ হয়েছে কিনা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা, কিন্তু ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া যে বারবার বিশ্ববাসীর কাছে তাদের খেলোয়াড়দের ভাবমূর্তি জোরপূর্বক ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছে সেটা বেশ প্রমাণিত। এটা হতে পারে যে স্যান্ডপেপার কেলেঙ্কারির পর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এই ভাবমূর্তি ভাল করার একটা মিশন নিচ্ছে, কিংবা অন্য যেকোন কারণই হোক- অজি ক্রিকেটের ঐতিহ্য তো আসলে এমন নয়।
ডকুমেন্টারি সিরিজ ‘দ্য টেস্ট: আ নিউ এরা ফর অস্ট্রেলিয়ান টিম’-এর কথাই ধরা যাক। সেখানে দেখানো হয় ২০১৮ এর পার্থ টেস্ট বিরাট কোহলি কিভাবে স্লেজিংয়ে জড়িয়ে পড়েন। দেখা যায় পেইন ল্যাংগারের সাথে এটা নিয়ে আলোচনাও করছেন। এরপর টিম পেইন এটা বলেন যে, ‘বিরাট কোহলি তাঁর লাইন ক্রস করে ফেলেছেন।’
কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গারও তাঁর অধিনায়ককে সমর্থন দিয়েছেন, ‘একবার ভাবুন তো যদি আমাদের ক্যাপ্টেন এমন করত। বিরাট যেটা করেছে সেটা হল ডাবল-স্ট্যান্ডার্ড।’
সেই দৃশ্যে দেখা যায়, স্লেজিং যা করার বিরাটই শুরু করেছিল। টিম পেইন, যিনি কিনা ব্যাগি গ্রিনের অধিনায়ক স্লেজিং থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। মাঠে দর্শক হিসেবে যেটুকু দেখা গেছে সেটুকুর প্রেক্ষিতে যদি বলতে হয়, তাহলে বলতে হচ্ছে-
অস্ট্রেলিয়ার একজন অধিনায়ক স্লেজিংয়ের স্বীকার হয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন!
তবে মজার ব্যাপার হল, পার্থ টেস্ট শুরুর আগে দুই অধিনায়কই একমত হয়েছিলেন যে মাঠে ছোটখাট ব্যান্টার হতেই পারে ,যদি সেখানে একেবারে নোংরা কাদা ছোঁড়াছুড়ি না হয়। তা কাদা ছোঁড়াছুড়ির ব্যাপার কিন্তু খেলোয়াড় নয়, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াই শুরু করে।
আগেই বলা হয়েছে, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাদের খেলোয়াড়দের ভাবমূর্তি জোরপূর্বক ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের একটা চেষ্টা করে আসছিল। আর সেই জন্যেই হয়ত, পার্থ টেস্টের একটা ক্লিপ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া আপলোড করে। সেখানে স্ট্যাম্প মাইকের কথাগুলো উচ্চ ভলিউমে দিয়ে, পেছন থেকে কমেন্ট্রি সরিয়ে নেওয়া হয়। যেন বিশ্ববাসীকে দেখানো, ‘দেখো, আমাদের খেলোয়াড়েরা একদমই বিতণ্ডায় জড়ায়নি।’
তবে হাস্যকর ব্যাপার হল, এই ঘটনার এক বছর আগে ভারতের সাথেই টেস্ট ম্যাচে ম্যাথ্যু ওয়েড রবীন্দ্র জাদেজার সাথে বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। তখন বিসিসিআইও স্ট্যাম্প মাইকের ক্লিপ আপলোড করেছিল। আর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তখন এটাকে ‘হতাশাজনক’ আখ্যা দিয়েছিল। বিসিসিআই পরে সে ক্লিপ সরিয়ে নেয়।
হাস্যকর না?
- কালের পরিক্রমা
২০১৭ এর দিকে ফিরে যাওয়া যাক। অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ রিভিউ নেবেন নাকি নেবেন না এমন একটা পরামর্শের জন্যে মাঠে থাকা অবস্থায় ড্রেসিং রুমের দিকে সাহায্যের জন্যে তাকান। কোহলি সেসময় তাকে বাধা দেয়। এরপর প্রেস কনফারেন্সে এসে স্মিথ তাঁর কাজকে কাকতালীয় আখ্যা দিয়ে বলেন এটা ছিল একটা ‘ব্রেইন ফেড মোমেন্ট’। পুরো আলোচনা তিনি এখানেই থামিয়ে দেন।
এখন? প্যাটার্নটা কিন্তু বদলে গেছে। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক এখন মাঠে কিছু করেন, বাসায় ফিরে যান, নিজেই এগুলো নিয়ে কথা বলেন, একটা বেশ আবেগঘন উষ্ণ বার্তা দেন আর নিজের কাজের জন্যে ক্ষমা চান। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও প্রমাণ করার চেষ্টা করে তাদের খেলোয়াড়দের ভাবমূর্তি অনেক উঁচুতে।
আগের অধিনায়কদের সাথে পেইনের পার্থক্য বুঝতে পেইনের একটা বার্তাই যথেষ্ট, ‘আমি মাঝে মাঝে আমার ভাষায় সংযত হওয়ার বদলে বাজে উদাহরণের তৈরি করি। আমি এজন্যে নিজের ওপরই হতাশ। আমি জানি স্ট্যাম্প মাইক চালু আছে আর অনেক শিশুরা খেলাটা দেখছে। আমার আরো ভাল উদাহরণ স্থাপন করা উচিৎ।’
তার মানে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের অধিনায়ক মনে করেন তাকে ক্রিকেট মাঠে সংযত হতে হবে কারণ এই খেলাটা অনেক শিশুই দেখে। এই কথাটা কি আগে প্রযোজ্য ছিল না? ২০১৩ তে যখন অ্যাশেজে গ্যাবা টেস্টে মাইকেল ক্লার্ক জেমস অ্যান্ডারসনকে বলেন, ‘গেট রেডি ফর দা ফাকিং ব্রোকেন আর্ম’ তখন? কিংবা ইউটিউবেই যে ক্লার্কের স্লেজিং গুলোর ভিডিও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া সগর্বে আপলোড করে রেখেছে, সেগুলো?
মিল পাওয়া যায়?
- স্পোর্টিং আইকন?
যুগ পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট। আম্পায়ার মার্ক বেনসনের দিকে তেড়ে গিয়ে ‘মাইকেল ক্লার্কের ওটা ক্যাচ ছিল, সৌরভ গাঙ্গুলি আউট’ বলা অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের দেশ এখন ক্রিকেটের মধ্যে ভালোমানুষির স্পিরিট যোগ করতে চাইছে। ২০০৮ এর সিডনি টেস্টের ন্যাক্কারজনক কাণ্ডের দেশ তাঁদের খেলোয়াড়দের ভাবমূর্তি সবার কাছে বড় করতে চাইছে।
তা চাইতেই পারে। সেটা অপরাধ নয়। কিন্তু মাঠের প্রতিটা স্লেজিং নিয়েই কথা বলা, সেটা বিচার করে নিজেদের খেলোয়াড়কে ভাল বানিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে দোষ দেওয়া? কিংবা অধিনায়কের নিজেরই মাঠের ঘটনা নিয়ে বাইরে ক্ষমা চাওয়া?
বিরাট কোহলিকে কখনও দেখা গেছে মাঠের স্লেজিং নিয়ে বাইরে কথা বলতে? যায়নি। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া চাইছে ভালোমানুষিতে নিজেদের একটা ‘স্পোর্টিং আইকন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যেটা তারা কখনই ছিল না। কেউ যখন জোরপূর্বক কিছু প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেখানে অহেতুক কান্ড থাকে, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ারও হয়েছে ঠিক তাই। নিজেদের তারা ‘স্পোর্টিং আইকন’ বানাতে চাইতেই পারে, কিন্তু সেখানে অহেতুক বার্তা প্রচার বেশি বাড়াবাড়িই হয়ে যায়!
অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট আবেগ দিয়ে খেলাটা খেলতেই পারে, সীমা অতিক্রম না করে স্লেজিং করতেই পারে, চাইলে নাও করতে পারে। কিন্তু মাঠের প্রতিটা ঘটনা নিয়ে বাইরে কথা বলা, জাস্টিফাই করা আসলে কোনভাবেই বিচক্ষণতা নয়!
তাই না?