লাঠি না ভেঙে স্লেজিংয়ের সাপ মারা!

অস্ট্রেলিয়ানরা কখনই চাইত না এটা ঘটুক।

কি সেটা? স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন ডেলিভারির মাঝে অন করে রাখা। এই চাওয়ার কারণটাও বেশ পরিষ্কার- স্লেজিং। সেসময়কার অস্ট্রেলিয়া দল স্লেজিংটাকে তো ক্রিকেটের একটা অংশই মনে করত। একটা ডেলিভারি করা হয়ে গেলে, আর আরেকটা ডেলিভারির মাঝে ওরা ‘টুকটাক’ স্লেজিং চালিয়েই যেত। আর ওদের এই স্লেজিংয়ে বাধ সাধল স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন। অস্ট্রেলিয়ানরা যাই বলে, তাই দেখা যায় ব্রডকাস্টিংয়ে শোনা যায়। কি বিপদের কথা!

এই ওভারের মাঝখানে স্লেজিং চালিয়ে নিতে অদ্ভুত এক কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া দল। আর সেই গল্পটাই শোনা যাক গোড়া থেকে।

ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ব্রডকাস্টাররা অস্ট্রেলিয়াকে কিন্তু এই বিপদ থেকে ঠিকই উদ্ধার করেছিল। সেসময়কার ব্রডকাস্টার ‘চ্যানেল নাইন’ যে কাজটা করত সেটা হল- ডেলিভারি ছোঁড়ার পর তারা স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনের ভলিউম নিচে নামিয়ে দিত, এতে করে পারতপক্ষে স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন থেকে কিছুই শোনা যেত না। কিন্তু এরপর বোলার আবার রানআপ নেওয়া শুরু করলে স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দিত। চ্যানেল নাইন মূলত এই কাজটা করার জন্যেই আলাদা অপারেটর নিয়োগ করেছিল!

ঘরের মাঠে বিপদ কাটাতে পারলেও, ঘরের বাইরে তখনও বিপদ বেশ বেড়েই চলছিল। বিশেষ করে, ঘরের মাঠে অভ্যস্ততার কারণে ঘরের বাইরে তারা তাদের এই ‘স্লেজিং’ এর বদভ্যাস থেকে বের হতে পারত না। আর তাই অ্যাওয়ে সিরিজগুলোতে তখনকার অস্ট্রেলিয়া দলের মূল চাওয়া ছিল এই স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনের ভলিউম বাড়ানো-কমানো। কিন্তু, চ্যানেল নাইন নাহয় এ কাজের জন্যে আলাদা অপারেটর রেখছিল, বিশ্বের সব ব্রডকাস্টারের তো এই কাজ করতে বয়েই গেছে!

এই যে গল্পটা এখন লেখা হচ্ছে, তার কারণও এই ব্রডকাস্টিং।

২০০৬ সালের ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজার স্টিভ বার্নার্ড প্রথমেই তাদের এই চাওয়া জানিয়ে দেয়। সেটাও আবার সোজাসুজি ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রডের কাছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, বিশ্বের সব ব্রডকাস্টারের তো আর অস্ট্রেলিয়ার আবদার মেটানোর ঠ্যাকা পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ার দলের ‘আবদার’ তাই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। সে সিরিজে বেশ কয়েকবার অস্ট্রেলিয়ার স্লেজিং স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে। যেটা অস্ট্রেলিয়ানরা কখনোই চাইত না।

দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর ছিল বাংলদেশ সফর। এই সফরেও এসে অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের চিরাচরিত দাবি এড়াতে পারল না। কিন্তু এবারও বিধি বাম, বাংলাদেশের হোম সিরিজের ব্রডকাস্টিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্রডকাস্টার প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ানদের দাবি নাকচ করে দেয়। পরপর দুবার তাদের এমন দাবি নাকচ হতে দেখে অস্ট্রেলিয়ানরা এক অদ্ভুত ফন্দি আঁটে। আর সেই ফন্দি বাস্তবায়ন করেন এমন একজন, যিনি কিনা উইকেটকিপার হয়েও, একজন অস্ট্রেলিয়ান হয়েও উইকেটের পিছনে ছিলেন একদম শান্ত- অ্যাডাম গিলক্রিস্ট!

তিনি এবার পুরো ব্যাপারটা সামলানোর দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেন!

বাংলাদেশ সফরের প্রথম টেস্ট। প্রথম দিন পার হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের সমস্যা থেকে বের হতে পারেনি। ঘটনাটি তারা ঘটাল তাই প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিনে।

উইকেটের পিছনে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। আর ডেলিভারির মাঝপথে তখন স্ট্যাম্প মাইক্রোফোন অফ হয়নি। হঠাৎই তিনি একটু জোরেই বলতে শুরু করলেন, ‘কাম অন বিং, ট্রেভেলেক্স-এ ছেলেদের জন্যে একটা কর, মাইলো এনার্জি বার-এ অনেক শক্তি আছে। ছেলেরা, এটাকে ক্যাস্ট্রলের সাথে ভালভাবে রাখো, কাম অন!’

ট্রাভেলেক্স, ক্যাস্ট্রল, মাইলো এনার্জি বার- এসব ছিল তখন অস্ট্রেলিয়া আর অ্যাডাম গিলক্রিস্টের স্পন্সরের নাম। নিজেদের স্পন্সরের নাম এভাবে বলার কারণ হল- প্রতিটা সিরিজে ঘরের মাঠের দলের, ব্রডকাস্টারদের পেছনে অনেক প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করে থাকে। ক্রিকেটের মূল বাণিজ্যটাই মূলত এখানে চলে। স্পন্সরদের কাছ এসমস্ত সিরিজের অনেক ব্যাপার অনেক সময় জিম্মিও থাকে। তো কোন স্পন্সর তাঁদের টাকায় স্পন্সরড হওয়া সিরিজে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের নাম শুনতে চাইবে?

অস্ট্রেলিয়া মূলত এই সুযোগটাই নিয়েছিল। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নাম বলে ব্রডকাস্টারদের একটা ‘বিপদ’এর মধ্যে ফেলে দিল। ফলাফল? যেকোনভাবেই হোক ব্রডাকাস্টারদের এ সময়ে স্ট্যাম্প মাইক্রোফোনের ভলিউম কমাতেই হত! স্পন্সর করা প্রতিষ্ঠান নাহলে ক্ষেপে যাবেনা!

অস্ট্রেলিয়া তাদের এই বুদ্ধি কিন্তু আরেকবারও কাজে লাগিয়েছিল, ২০১৮ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে!

লাঠি না ভেঙে সাপ মেরে ফেলা বুঝি একেই বলে!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link