ব্যর্থতার ঝড়ে যা যা পাল্টাচ্ছে

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের ক্রিকেট যে একটা ঝড়ের ভেতর পড়ে গিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনুমান মতই কিছু ক্ষত সারানোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বোর্ড। সেই উদ্যোগে কাটা পড়তে যাচ্ছে কিছু নাম, কিছু নাম যোগ হবে এবং বেশ কিঠু নতুন নতুন সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, একটা ওলট পালট হতে চলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে।

এই ঝড়টার স্বরূপ কী হবে, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন থাকলেও এখনও বোর্ডের তরফে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। তবে এরই মধ্যে বোর্ডের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে একাধিক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবালকে নিজের বাসায় ডেকে বৈঠক করেছেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

কোথাও থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য জানা যায়নি। তবে কিছু উড়ো খবর, সূত্রের খবর আমাদের বলছে যে, পরিবর্তনগুলো এরকম হবে। সেগুলোকেই এক জায়গায় করার একটা চেষ্টা করি, চলুন।

  • অধিনায়ক

অধিনায়কত্ব নিয়ে একটা বিপাকের মধ্যে আছে বিসিবি। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তারা মূলত চায়, তিন ফরম্যাটে এক অধিনায়ক জহবেন এবং তিনি হবেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু সাকবের সম্মতি না পাওয়ায় সেই সিদ্ধান্তও ঝুলে আছে।

একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, পাকিস্তান সিরিজের পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে আর টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক রাখা হচ্ছে না। সাকিব সম্মতি দেবেন কি না, নিশ্চিত না হওয়ায় তামিম ইকবালকে প্রস্তাব করা হয়েছিলো টি-টোয়েন্টিরও দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। কিন্তু তামিম ‘না’ করে দিয়েছেন। তিনি এই ফরম্যাটে আর খেলবেনই না।

এ অবস্থায় সাকিব রাজী হলে তো একটা সমাধাণ এলো। না হলে টেস্টে মুমিনুল হয়তো আরও কিছুদিন টিকে যাবেন; তবে সেটাও নির্ভর করছে পাকিস্তান সিরিজের পারফরম্যান্সের ওপরে। আর ওয়ানডেতে তামিমই থাকবেন। টি-টোয়েন্টিতে হয়তো আমরা আনকোরা মুখ দেখবো।

  • কোচ

বিসিবি এই কোচ নিয়ে একটা ফাঁদে পড়েছে। বলা যায়, খানিকটা ‘ব্লাকমেইল’ করে বিশ্বকাপের আগে দুই বছরের নতুন চুক্তি করে নিয়েছেন রাসেল ডমিঙ্গো। তিনি বলেছিলেন, তার হাতে তাসমানিয়ার অফার আছে। তাকে রাখতে চাইলে এখনই চুক্তি করতে হবে। নইলে তিনি বিশ্বকাপেও থাকবেন না।

এখনই কোচ কোথা থেকে পাওয়া যাবে, এই দুশ্চিন্তা থেকে বোর্ড তড়িঘড়ি ডমিঙ্গোর দাবি মেনে নেয়। এরপর বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর বোর্ড তাকে বরখাস্ত করতে চাচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হলো, নতুন চুক্তিতে পরিষ্কার আছে যে, ডমিঙ্গোকে বরখাস্ত করলে তাকে পুরো দুই বছরের বেতন বুঝিয়ে দিতে হবে।

বিসিবি এখন এতোটাই মরীয়া যে, দুই বছরের আক্কেল সেলামি দিয়ে হলেও ডমিঙ্গোকে বিদায় করতে চায় তারা।

  • ফারুক ইন, নান্নু আউট

বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল প্রধাণ নির্বাচক ফারুক আহমেদ। দেশের সফল দুই বিশ্বকাপ অভিযান, ২০০৭ ও ২০১৫ সালের দল গঠনের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সফলতম এক ঝাক ক্রিকেটারকে তুলে এনেছেন তিনি। কিন্তু বোর্ডের সাথে কতৃত্ব নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এবার বোর্ড চাচ্ছে সেই ফারুককে আবার ফিরিয়ে আনতে।

মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর সময়ের ফলাফল খুব সুবিধের না। বিশেষ করে গত কয়েকটি আসরে তার নির্বাচিত দল সবসময়ই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ফলে তাকে সম্ভবত বিদায়ই নিতে হচ্ছে। তবে নির্বাচক হিসেবে হাবিবুল বাশার ও আব্দুর রাজ্জাক টিকে যাচ্ছেন।

  • হাতুরুসিংহে ও সিডন্স

হ্যাঁ, এটা চমক জাগানিয়া খবর। সম্ভবত বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে আবার ফিরছেন সাবেক এই দুই কোচ।

চান্দিকা হাতুরুসিংহেকে জাতীয় দলেরই প্রধান কোচ করার ইচ্ছে বোর্ডের। তিনি বর্তমান চাকরি আগস্টের আগে ছাড়তে পারবেন না। তাই সে পর্যন্ত ডমিঙ্গোকে রেখে দেওয়া বা অর্ন্তবর্তীকালীন কোচ নিয়োগ দেওয়ার একটা করবে বিসিবি। তারপর হাথুরুর হাতে লম্বা মেয়াদে দলকে তুলে দেওয়া হবে।

এ ছাড়া ফিরতে যাচ্ছেন সম্ভবত সাবেক কোচ জেমি সিডন্সও। তবে জাতীয় দলে ফিরবেন না তিনি। তাকে ক্রিকেট ডিরেক্টর বা এরকম বড় কোনো ক্রিকেট পদ দিয়ে আনা হবে। যার হাতে ক্রিকেট ও জাতীয় দল পরিকল্পনার দায়িত্বটা থাকবে।

  • কোচিং স্ট্যাফ

বর্তমান কোচিং স্ট্যাফের পারফরম্যান্সেও বোর্ড খুব অসন্তুষ্ট। প্রধাণ কোচের কথা তো শুনলেনই। এ ছাড়া নিশ্চিত ভাবেই চাকরি খোয়াতে যাচ্ছেন ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক এবং বোলিং কোচ ওটিস গিবসন।

ব্যাটিং কোচ অ্যাশওয়েল প্রিন্সও আছেন তোপের মুখে। তাকে একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার পক্ষে অবশ্য কিছু মত আছে।

  • লিটন-সৌম্য-মুশফিক-রিয়াদ

তামিম টি-টোয়েন্টিতে থাকছেন না। সিনিয়রদের মধ্যে এখন আছেন মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক এবং মধ্যবয়সীদের মধ্যে লিটন দাস ও সৌম্য সরকার। চার জনই যাচ্ছেতাই পারফরম করছেন। এর মধ্যে লিটন ও সৌম্যকে টি-টোয়েন্টি থেকে ছেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

রিয়াদও সম্ভবত পাকিস্তান সিরিজের পর আর সুযোগ পাচ্ছেন না। মুশফিককে পাকিস্তান সিরিজে আরেকটা সুযোগ দেওয়া হবে। ব্যর্থ হলে টি-টোয়েন্টিতে তার অধ্যায় শেষ।

অর্থাত সাকিব আল হাসান ছাড়া সিনিয়র আর কেউ দলে থাকছেন না।

  • নবীনের জয়গান

এই সিনিয়রদের জায়গা নিতে দলে ডাকা হবে বেশ কিছু তরুণকে। এর মধ্যে অনূর্ধ্ব-১৯ দল থেকে পারভেজ হোসেন ইমন, তৌহিদ হৃদয় ও মাহমুদুল হাসান জয় ডাক পেতে পারেন। আসতে পারেন মুনিম শাহরিয়ারও।

  • সুজন টিম ডিরেক্টর

খালেদ মাহমুদ সুজনকে দলের সাথে চেয়ে অনেকেই সুপারিশ করেছেন। যতদূর জানা গেছে মাশরাফি-তামিম-সাকিবও এমন সুপারিশ করেছেন। ফলে তাকে দলে একটা স্থায়ী ভূমিকা দেওয়া হচ্ছে।

পাকিস্তান বিপক্ষে আসন্ন সিরিজেই সুজনকে ন্যাশনাল টিম ডিরেক্টর হিসেবে দেখা যাওয়ার কথা। এই দায়িত্বটা পরে স্থায়ী হতে পারে।

  • পাওয়ার হিটিং কোচ

বাংলাদেশের অন্যতম একটা সমস্যা হলো, ব্যাটসম্যানদের বড় বড় শট করতে না পারা। এই ব্যাপারটা বিশ্বকাপের সময়ে খুব সামনে এসেছে।

ব্যাটসম্যানদের টি-টোয়েন্টি স্কিল নিয়ে কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ কোচ আনার একটা চিন্তা আছে।

  • সালাহউদ্দিন গুঞ্জন

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবচেয়ে পছন্দের ও দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থানীয় কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সাকিব, মুশফিকদের এই গুরুকে অনেকদিন ধরেই জাতীয় দলে ফেরানোর দাবি ছিলো।

অবশেষে সেটা বিসিবি বিবেচনা করছে। আগে সহকারী কোচ ও ফিল্ডিং কোচের ভূমিকা পালন করা সালাউদ্দিনকে আবার সহকারী কোচ করার কথা ভাবছে বিসিবি। তেমন হলে তাকে হয়তো হাতুরুসিংহের সাথে জুটি বাঁধতে হবে।

  • ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি

এরকম একটা কমিটি করার প্রস্তাব এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ এবং করনীয় ঠিক করার জন্য এই কমিটি গঠনের সুপারিশ আছে। তবে বোর্ড এখনও এরকম কমিটি করার কথা ভাবছে না।

কমিটি হলে সেই কমিটি খেলোয়াড়, নির্বাচক, কর্মকর্তা, ম্যানেজমেন্ট, সাংবাদিক; এমনকি দর্শকদের সাথেও কথা বলার কথা ভাবা হচ্ছে।

  • মাশরাফির ভূমিকা

বোর্ড মাশরাফিকে জাতীয় দলে কোনো একটা ভূমিকায় দেখতে চায়। সেরকম একটা প্রস্তাবও তাকে দেওয়া হয়েছে। কী ভূমিকা, সেটা পরিষ্কার জানা যায়নি। তবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অনুমিতভাবেই সে প্রস্তাবে মাশরাফি ‘না’ বলেছেন। তবে এ ব্যাপারে অতি উচ্চ পর্যায় থেকে আগ্রহ আছে বলেও জানা গেছে।

  • আগ্রহহীনতা

খেলোয়াড়, কোচিং স্ট্যাফ, নির্বাচক; সকলেরই দোষ দেখছে বোর্ড। সকল জায়গায় পরিবর্তনের আভাস মিলছে। কিন্তু এই কাণ্ডে বোর্ডের কী দোষ নেই? সভাপতি ও বোর্ড কী দায় এড়াতে পারেন?

তাদের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্চ শোনা যাচ্ছে না।

উচ্চবাচ্চ নেই ঘরোয়া ক্রিকেট বা উইকেট নিয়েও। ভালো ফল করার জন্য এগুলো যে জরুরি, সেটা বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে এ বিষয়ে বোর্ড গুরুত্ব দিয়ে কিছু করতে যাচ্ছে, এমন কোনো খবর অন্তত শোনা যাচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link