আজ সকালে জহির রায়হানের ৪০০ মিটার দৌড় দিয়ে শেষ হয়ে গেল বাংক্লাদেশের অলিম্পিক যাত্রা। প্রতি অলিম্পিকের মতই বাংলাদেশ এবারও টোকিও পারি জমিয়েছিল আগের মোটো নিয়েই, হার-জিত বড় নয়, অংশগ্রহণই বড়।
এবার অবশ্য বাংলাদেশের লক্ষ্যটা একটু ভিন্ন ছিল। দ্বিতীয়বারের মতন বাংলাদেশ থেকে সরাসরি অলিম্পিকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন একজন প্রতিযোগী। প্রতিবারই বাংলাদেশ ডাক পায় অলিম্পিক কমিটির দেওয়া ওয়াইল্ড কার্ড থেকে। কিন্তু গলফার সিদ্দিকুর রহমানের পর এই প্রথম বাংলাদেশ আর্চার রোমান সানা সরাসরি অলিম্পিকে খেলবার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেই সাথে ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন আরো ৫ জন। ৬ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন মোট ৭টি ভিন্ন ভিন্ন ইভেন্টে। কেমন হলো বাংলাদেশি ৬ জনের অলিম্পিক যাত্রা?
- আর্চারি মিশ্র ইভেন্ট: (রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী)
বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের প্রথম ম্যাচ ছিল ২৪ জুলাই। টোকিওর ইয়ুমেনোশিমা পার্কের আর্চারি গ্রাউন্ডে অলিম্পিক আর্চারির মিশ্র ইভেন্টের প্রথম রাউন্ড। অলিম্পিক আর্চারিতে রিকার্ভের মিশ্র ইভেন্টের চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিলেন রোমান সানা-দিয়া সিদ্দিকী জুটি। ২৯টি দেশের মধ্যে সর্বশেষ দল হিসেবে ১৬তম হয়ে খেলবে চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছিল বাংলাদেশ।
নিয়ম অনুসারে বাছাইপর্বের সর্বশেষ দলটির সঙ্গে প্রথম রাউন্ডে মুখোমুখি হয় শীর্ষ দল। সেখানেই কপাল পিরেছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, আর্চারির রাজা যারা। তাতে করে হাল ছেড়ে দেননি তারা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৬-০ সেট পয়েন্টের ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ।
তিন সেটেই ভালো প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিলেন সানা-দিয়া জুটি। প্রথম সেটটাই বাজে হয়েছিল, ৩৮-৩০ পয়েন্ট ব্যবধানে প্রথম সেট হার মানেন তাঁরা। দ্বিতীয় সেটে সমান-সমান লড়াই করেও হার মানতে হয় ৩৫-৩৩ পয়েন্ট ব্যবধানে। তবে ত্ররতীয় সেটে এসে অসাধারণ খেলেছিলেন বাংলাদেশি দুই তিরন্দাজ। কিন্তু ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়া দক্ষিণ কোরিয়ার কিম জে দিওক ও আন সান জুটির সাথে পেরে উঠেননি সারা। ৩৯-৩৮ পয়েন্ট ব্যবধানে হেরে যান তাঁরা। দক্ষিণ কোরিয়ার জুটি নিজেদের অলিম্পিক যাত্রা শেষ করেন স্বর্ণপদক জিতে।
- ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শ্যুটিং: (আব্দুল্লাহ হেল বাকি)
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইভেন্ট ছিল ১০ মিটার এয়ার রাইফেল শ্যুটিং। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন দেশসেরা শ্যুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকি। কিন্তু টোকিওতে নিজের নামের সুনাম করতে পারেননি তিনি। আসাকা শুটিং রেঞ্জে নিজের গড়া রেকর্ডের ধারে কাছেও যেতে পারেননি তিনি। বাদ পরেছেন বাছাই পর্ব থেকেই।
কমনওয়েলথ গেমসে দুবারের রুপাজয়ী শুটারের স্বপ্ন ছিল অলিম্পিকের ফাইনালে খেলা। কিন্তু সে স্বপ্ন গুড়েবালি। ৪৭ প্রতিযোগীর মধ্যে ৬১৯.৮ স্কোর গড়ে ৪১তম হন বাকি। ছয় সিরিজে তার স্কোর ছিল যথাক্রমে ১০২.৮, ১০৩.৪, ১০২.৯, ১০৩.৮, ১০৩.৮ ও ১০৩.১ স্কোর। গড় স্কোর ছিল ১০.৩৩। যা তার মতন শ্যুটারের জন্যও বেশ বাজে।
- ছেলেদের আর্চারি রিকার্ভ: (রোমান সানা)
অলিম্পিকে যাওয়া ৬ জনের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আশা ছিল এই জায়গা থেকেই। গত তিনবছর ধরে যে ধারাবাহিকতার দেখা দিয়েছেন রোমান সানা, তাতে করে এই ইভেন্টে অনেক দূর যাওয়ার আশা করেছিল বাংলাদেশ। কেউ কেউ তো মেডেল জেতার স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু তেমনটা হয়নি, তবে রোমান সানা হতাশও করেননি। অলিম্পিকে প্রথমবারের মতন কোনো ইভেন্টে জয় তুলে এনেছেন রোমান সানা।
প্রথম রাউন্ডে রোমান ৭-৩ সেট পয়েন্টে হারিয়েছেন গ্রেট ব্রিটেনের টম হলকে। ৫ সেটে গড়ানো খেলায় নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছেন সর্বদাই। প্রথম সেট ২৮-২৮ পয়েন্টে ড্র হলেও এরপরই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ২৭-২৫, ২৭-২৬ পয়েন্ট নিয়ে পরপর দুই সেট জিতে নেন। পরের সেটে খেই হারিয়ে ২৫-২৭ এ হেরে গেলেও শেষ সেটে গিয়ে নিজের খেলা দেখিয়েছেন সানা। ২৯-২৭ পয়েন্টে জিতে নেন ম্যাচ।
কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়েই ছেদ পরে সেই স্বপ্নযাত্রার। কানাডার ডুনাস ক্রিস্পিনের বিপক্ষে বেশ ভালোই লড়াই চালিয়েছিলেন সানা। কিন্তু শেষটা ঠিকমতো করতে না পারার খেসারত দিতে হয়েছে ম্যাচ হেরে। শেষ শটে গিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ম্যাচের ফল।
প্রথম সেটে জিতেছিলেন সানা, ২৬-২৫ পয়েন্টের ব্যবধানে পেছনে ফেলেছিলেন ডুনাস ক্রিস্পিনলে। কিন্তু পরের দুই সেটেই ফেরত আসেন ডুনাস। ২৮-২৫৫, ২৯-২৭ পয়েন্ট নিয়ে এগিয়ে যান ডুনাস। চতুর্থ সেট সানা নিজের করে নেন ২৭-২৬ পয়েন্টের ব্যবধানে। কিন্ত উশেষ সেটে শেষ শটে গিয়েই গোলমাল করে ফেলেন সানা।
সর্বশেষ সেটের প্রথম শটে রোমান মারেন ৯, ডুয়েনাস মারেন ৭। পরের শটে রোমানের ৮-এর জবাব ডুনাস দিয়েছেন ১০-এ। দুজনের পয়েন্ট তখন সমান ১৭। শেষ শটে ডুনাস ৯ মারলেও রোমান মারেন ৮। এক পয়েন্টের ব্যবধানে অলিম্পিক থেকে বিদায় নিতে হয় রোমান সানাকে।
- মেয়েদের আর্চারি রিকার্ভ: (দিয়া সিদ্দিকী)
রোমান সানার বিদায়ের পর বাংলাদেশের আর্চারিতে আশা ছিলেন দিয়া সিদ্দিকী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে তিনি বিদায় নিয়েছেন টাই-ব্রেকার থেকে। মেয়েদের রিকার্ভ এককে প্রথম রাউন্ডে দিয়াকে বিদায় নিতে হয়েছে ৬-৫ সেট পয়েন্টে বেলারুশের কারিনা দিওমিনসকায়ার কাছে হেরে।
জয় দিয়ে প্রথম সেট শুরু করেন দিয়া। এরপর সমতায় ফেলেন কারিনা। তৃতী সেট ড্র, চতুর্থ আর পঞ্চম যথাক্রমে কারিনা আর দিয়া জিতে নিলে শুরু হয় টাই-ব্রেকার। আর সেখানেই ৬-৫ সেটে হেরে বিদায় নিতে হয় দিয়াকে। দিয়া-কারিনার স্কোরকার্ড দেখলেই বোঝা যায় শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছেন দুজনে। ২৩-২২, ২৫-২৬, ২৫-২৫, ২৫-২৭, ২৭-২৫, ৫-৬। কিন্তু শেষ হাসিটা হাসা হয়নি দিয়ার।
- ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতার: (আরিফুল ইসলাম)
৫০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে নিজেকে আবারও প্রমাণ করেছেন দেশসেরা সাঁতারু আরিফুল ইসলাম। তাকে নিয়ে তেমন কোনো আশা ছিল না। কিন্তু এই আশা না থাকাই বরং ভালো হয়েছিল তার জন্য। সাঁতারের হিটে ছাড়িয়ে গিয়েছেন নিজেকে। এমনকি সেরা তিনেও জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।
সাতারের চার নম্বর হিটে ৫০ মিটার পাড়ি দিতে মোট সময় নিয়েছেন ২৪.৮১ সেকেন্ড। নিজের হিটে ৮ জনের মাঝে হয়েছেন তৃতীয়। সেই সাথে নিজের সেরা সময় ২৪.৯২ সেকেন্ডকেও পেছনে ফেলেছেন অলিম্পিকে গিয়ে। যদিও সেমিতে উঠার দৌভাগ্য হয়নি, তবুও ব্যক্তিগত রেকর্ডই তার গর্বের জায়গা।
- ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতার: (জুনায়না আহমেদ)
আরিফুল ইসলামের পর জুনায়না আহমেদেরও লক্ষ্য ছিল নুইজের সেরা টাইমিংটা ছোঁয়া। সেটা পেরেছেন, কিন্তু সেমিতে উঠার সৌভাগ্য হয়নি তার। আগের সেরা টাইমিং থেকে ১.১৮ সেকেন্ড সময় কম নিয়ে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলের হিট জুনায়না আহমেদ শেষ করেছিলেন ২৯.৭৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে। আটজনের মধ্যে হয়েছিলেন পঞ্চম।
- ৪০০ মিটার দৌড়: (জহির রায়হান)
বাংলাদেশের সব প্রতিযোগীর মধ্যে সবচেয়ে বাজেভাবে শেষ করেছেন দৌড়বিদ জহির রায়হান। দৌড়ের হিট শেষ হয়ে যখন প্রতিযোগীরা আনন্দে বিহ্ববল, তখনও দৌড়ে চলেছেন বাংলাদেশের অ্যাথলেট জহির রায়হান। নিজের হিটেও সর্বশেষ পজিশনে থেকে শেষ করেছেন জহির রায়হান।
৪৪.৮২ সেকেন্ড সময় নিয়ে হিটে প্রথম হয়ে সেমিফাইনালে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাথলেট মাইকেল চেরি। আর ৪৮.২৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে আটজনের মধ্যে অষ্টম হয়ে হিট শেষ করেন জহির। নিজের সেরা টাইমিং থেকেও ০.৯৫ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়ে দৌড় শেষ করেন রিনি। আর তাঁকে দিয়েই ইতি টানা হয় বাংলাদেশের টোকিও অলিম্পিক যাত্রা।