ছক্কায় খুললো খাতা

টেস্ট মানেই লোকেরা মনে করে, সারাদিন ঠুকঠুক।

চার-ছক্কা খুব একটা দেখা যাবে না, ব্যাটসম্যানরা সারাদিন ধরে বল ঠেকাবেন আর ঠেকাবেন। এই যেনো টেস্ট সম্পর্কে ধারণা। কিন্তু সেই আদিকাল থেকে অনেক টেস্ট ব্যাটসম্যানই এর বিপরীত মেজাজে ব্যাট চালিয়েছেন। এই যেমন কিছুদিন আগের শেবাগ বা গেইলের কথা ধরুন। তারা রীতিমতো তান্ডব করেছেন টেস্ট ক্রিকেটে।

এই ফরম্যাটেই আপনারা এমন কিছু খেলোয়াড়ের দেখা পাবেন, যারা রীতিমতো ছক্কা মেরে নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন।

যেখানে টেস্ট ক্রিকেটে ছক্কার দেখা পাওয়া অমাবস্যার চাদের মত সেখানেই এই কান্ড ঘটিয়ে বসেছেন কিছু ক্রিকেটার। এই তালিকাটা খুবই ছোটো নয়। এই তালিকায় আছেন ১২ জন ক্রিকেটার যারা কিনা নিজেদের টেস্ট ক্যারিয়ার প্রথম রান দেখা পেয়েছেন ছক্কার মাধ্যমে।

এর মধ্যে বাংলাদেশী চার খেলোয়াড়ও আছেন। এর মধ্যে তিন বাংলাদেশীই মূলত বোলার। তারপরও তারা ছক্কা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। এই এক ডজন খেলোয়াড়ের গল্প জেনে নেওয়া যাক।

  • এরিক ফ্রিম্যান (অস্ট্রেলিয়া)

এরিক ফ্রিম্যান প্রথম ক্রিকেটার যিনি কিনা ছক্কা মেরে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের খাতা খুলেছেন। এই ব্যাটিং অলরাউন্ডারের টেস্ট অভিষেক ১৯৬৮ সালে ব্রিসবেনে। প্রতিপক্ষ উপমহাদেশের দল ভারত। নিজের টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম দুই বলেই মাঠের বাইরে বল পাঠান তিনি।

এতো বড় উড়ন্ত সূচনার পরও ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ এবং সাফল্য মন্ডিত করতে পারেননি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন মাত্র ১১ টেস্ট। ব্যাটিং গড় ১৯.১৬ এবং বোলিং গড় ছিলো ৩৩.১৭ । ক্রিকেটার হিসেবে ব্যর্থ হবার পর তিনি তরুন ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করেন। এছাড়াও তিনি অস্ট্রেলিয়ান এবিসি রেডিও তে ধারাভাষ্যকার এবং পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে কাজ করেন।

এরিক ফ্রিম্যানই প্রথম এই ধরণের তালিকা করা শুরু করেন কারা নিজেদের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম বলেই ছক্কা মেরেছেন।

  • কার্লিসলি বেস্ট (ওয়েস্টইন্ডিজ)

এরিক ফ্রিম্যানের পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন কার্লিসলি বেস্ট। ১৯৮৬ সালে জাম্যাইকাতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। বেস্ট যখন জাতীয় দলে খেলেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ছিলো অপরাজেয়। আর সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে নিয়মিতই জয় পাচ্ছিলো।

বেস্ট তার টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম বল মোকাবিলা করেন ইংলিশ গ্রেট ইয়ান বোথামের বল। বোথাম কার্লিসলি বেস্টকে প্রথম দুই বলে দুইটি বাউন্সার দিয়েছিলেন। তৃতীয় বলে ছক্কা মেরে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের খাতা খোলেন।

বেস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছিলেন ৮ টেস্ট। অভিষেকের ৪ বছর পর ক্যারিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র সেঞ্চুরি করেন কার্লিসলি বেস্ট।

  • কেইথ ড্যাবেংয়া (জিম্বাবুয়ে)

যদিও জিম্বাবুয়ে এখন ক্রিকেটে টিকে থাকতে লড়াই করছে, কিন্তু কিছু বছর আগেও ক্রিকেটে পরাশক্তি হবার পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো জিম্বাবুয়ে । ঐ সময়ে অভিষেক হয় কেইথ ড্যাবেংয়ারের।

২০০৫ সালে বুলাওয়েতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। প্রথম রান করার জন্য ১৫টি বল মোকাবিলা করতে হয় তাকে। ড্যানিয়েল ভেট্টরিকে ছক্কা মেরে টেস্ট ক্যারিয়ারের নিজের রানের খাতা খুলেন কেইথ ড্যাবেংয়া। ক্যারিয়ার মাত্র তিনটি টেস্ট খেলেন কেইথ ড্যাবেংয়া।

  • ডেল রিচার্ডস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

ডেল রিচার্ডসের অভিষেকটা অন্যান্য সবার মত নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে যখন সিনিয়র সকল ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তখনই বাংলাদেশের বিপক্ষে সেন্ট লুসিয়াতে অভিষেক হয় ডেল রিচার্ডসের।

মাশরাফির বলে ছক্কা মেরে টেস্ট ক্রিকেটে রানের খাতা খুলেন রিচার্ডস। কিন্তু এই উড়ন্ত সূচনার পরও মাত্র দুই টেস্টে ক্যারিয়ার শেষ হয় ডেল রিচার্ডসের।

  • শফিউল ইসলাম (বাংলাদেশ)

প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ছক্কা মেরে টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের খাতা খুলেন শফিউল। ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে এই রেকর্ড করেন তিনি। এই একটি ছক্কা মারার জন্য ৭ টি বল খেলতে হয় তাকে।

ভারতীয় স্পিনার অমিত মিশ্রর বলে ছক্কা হাকান এই বাংলাদেশি পেসার। বর্তমানে জাতীয় দলের বাইরে আছেন শফিউল। সর্বশেষ সাদা পোষাকে দেখা গিয়েছিলো ২০১৭ সালে। মাত্র ১৭ টি টেস্ট উইকেট নিতে পেরেছেন তিনি। টেস্ট পারফর্মেন্স ভালো না থাকায় টেস্ট দলের জন্য বিবেচনা করা হয় না শফিউলকে।

  • জহুরুল ইসলাম অমি (বাংলাদেশ)

জহুরুলের টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু ভয়ংকরভাবে। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংলিশ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ানের লেগ স্পিনে পড়ে কোনো রান না করেই সাজ ঘরে ফিরতে হয় তাকে। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুটা ঘুরে দাড়ান তিনি। খেলেন ৪৩ রানের একটি ইনিংস। রানের খাতা খুলেন ছক্কা মেরে। বোলার ছিলেন প্রথম ইনিংসে আউট করা বোলার সোয়ান। জহুরুল পরবর্তীতে বাংলাদেশের হয়ে খেলেন ৭ ম্যাচ। ইনজুরি এবং বিভিন্ন সমস্যার কারনে পরবর্তীতে আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি।

  • আল আমিন হোসেন (বাংলাদেশ)

আল আমিন ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের অভিষেক টেস্টে শূন্য রানে সাজ ঘরে ফেরেন। পরবর্তীতে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের রানের খাতা খুলেন ২০১৪ সালে।

বোলার হিসেবে ছিলো লংকান স্পিন গ্রেট রঙ্গনা হেরাথ। জাতীয় দলের খেলতে পেরেছেন মাত্র ৭ টেস্ট। আল আমিন নিজেকে দূর্ভাগা ভাবতে পারেন। সম্ভাবনাময়ী বোলার হবার পরও যথেষ্ঠ সু্যোগ পাননি। এছাড়াও ২০১৫ বিশ্বকাপের সময় জাতীয় দলের নিয়ম ভাঙ্গার অপরাধে দল থেকে বাদ পড়েন। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলে নিয়মিত হতে পারেননি।

  • মার্ক ক্রেইগ (নিউজিল্যান্ড)

মার্ক ক্রেইগ একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি কিনা নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম বলেই ছক্কা মেরেছেন। ২০১৪ সালে কিংস্টনে লম্বাদেহী সুলেমান বেনকে ছক্কা মেরে এই রেকর্ডের ভাগ বসান ক্রেইগ। তাকে মূলত দলে নেয়া হয়েছিলো স্পিনার ইশ সোধির বিকল্প হিসেবে।

অভিষেক টেস্টে ৮ উইকেট নিয়ে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন। এরপর ইশ সোধি দলে ফেরায় দলে জায়গা হারান তিনি। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় পারফর্ম করে আবার দলে আসেন ক্রেইগ। পাকিস্থানের বিপক্ষে টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ থেকে তার পারফর্মেন্স নামতে থাকে। এরপর আর ঘুরে দাড়াতে পারেননি মার্ক ক্রেইগ। দল থেকে বাদ পড়েন এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়ে পড়েন ব্রাত্য।

  • ধনঞ্জয়া ডি সিলভা (শ্রীলঙ্কা)

ডি সিলভা ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভালো করে জাতীয় দলে ঢোকেন। টেস্টে অভিষেকে প্রতিপক্ষ ছিলো অস্ট্রেলিয়া। টেস্টে ক্যারিয়ারে নিজের খেলা পঞ্চম বলে ছক্কা হাকান তিনি। এর মাধ্যমে টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের খাতা খুলেন। এখন পর্যন্ত শ্রীলংকার হয়ে ৩২ টেস্ট খেলেছেন।  নিয়মিতই জাতীয় দলের হয়ে পারফর্ম করছেন।

  • কামরুল ইসলাম রাব্বি (বাংলাদেশ)

কামরুল ইসলাম রাব্বি নজরে আসেন অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলার সময়ে। ৪৭ প্রথম শ্রেনির ম্যাচ খেলার পর ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় রাব্বির। এই সিরিজে মাত্র ১ উইকেট নেন রাব্বি। কারন বাকি সব  উইকেট স্পিনাররা তাদের নিজের পকেটে ভরেন।

ইংলিশ অলরাউন্ডার মঈন আলীকে ছক্কা মেরে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের রানের খাতা খোলেন রাব্বি। স্পিনারদের দাপটে এখন আর ঠিক মত জাতীয় দলে ডাক পাননা কামরুল ইসলাম রাব্বি।

  • সুনীল আমব্রিস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

এই ব্যাটসম্যান নিজের অভিষেক টেস্টে প্রথম বলেই হিট আউট হবার রেকর্ড গড়েন। এমনকি নিজের দ্বিতীয় টেস্টেও হিট আউট হন তিনি।

আমব্রিস নিজের প্রথম টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ড পেসার ট্রেন্ট বোল্টকে ছক্কা হাকিয়ে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের রানের খাতা খুলেন। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন মাত্র ৬ টেস্ট। টেস্টে তার ব্যাটিং পরিসংখ্যান ভালো না হওয়ার কারণে টেস্ট স্কোয়াডে জায়গা পান না। অন্য সংস্করণে জাতীয় দলে নিয়মিতই খেলছেন তিনি।

  • ঋষভ পান্ত (ভারত)

এই উইকেট কিপার ব্যাটসম্যানের টেস্ট অভিষেক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ইংলিশ স্পিনার আদিল রশিদকে ছক্কা হাকিয়ে নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম রান করেন তিনি।

বর্তমান সময়ে ভারতের হয়ে দূর্দান্ত পারফর্ম করছেন পান্ত। ভারতের হয়ে ৪০.৬৭ গড়ে করেছেন প্রায় এক হাজার রান।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link