বিশ্বমঞ্চের আগুন ঝরা বোলিং

ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটটা সাধারণত ব্যাটারদের স্বর্গরাজ্যই মনে করা হয়। কিন্তু কালেভদ্রে বোলাররাও যে ম্যাচের পুরো কৃতিত্ব নিজেদের করে নিতে পারে এমন ঘটনার নজির মিলবে ভুড়িভুড়ি। তবে বোলারদের অবদান যে একেবারেই থাকে না তা বলা স্রেফ একটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছু না। প্রায় প্রতিটি ম্যাচে বোলারদের আগুন ঝরা পারফর্মেন্সেই জিতে নেওয়া সম্ভব।

তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মহামঞ্চে একজন বোলার ব্যাটারদের সকল আলো নিভিয়ে দিয়ে হয়েছিলেন নিজেই আলোর সকল উৎস। জমকালো বিশ্বকাপ আয়জনের আলোর বিকিরণ ঘটিয়েছিলেন নির্দিষ্ট কোন এক ম্যাচে। আজ তেমনই কিছু বোলারদের নিয়ে আলোচনা হবে। আর স্মৃতিচারণ হবে তাঁদের বোলিং তাণ্ডবের।

  • অজন্তা মেন্ডিস (শ্রীলঙ্কা)

সালটা ২০১২, উপমহাদেশের ক্রিকেটীয় দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় বসেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চতুর্থ আসর। ঘরের মাঠে অপেক্ষাকৃত দূর্বল দল জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিকরা। গ্রুপ পর্বের ম্যাচ। আগে ব্যাট করে কুমার সাঙ্গাকারা, তিলকারত্নে দিলশান ও জীবন মেন্ডিসের ব্যাটে ভর করে ১৮২ রানের পুঁজি পায় স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। লড়াকু এবং জয়ে নিয়ে হোটেলে ফেরার জন্যে তা যথেষ্ট।

জয়টাকে আরো সহজ করে দিয়েছিলেন লঙ্কান ডানহাতি স্পিনার অজন্তা মেন্ডিস। দিনটা যেন পুরোপুরি নিজের করে নিয়েছিলেন তিনি।  নিজের নির্ধারিত বোলিং কোটা পুরণ করে নিয়েছিলেন দুইটি মেইডেন ওভার। বাকি দুই ওভারে রান দিয়েছিলেন মোটে আট। মানে ওভারপ্রতি মোটে দুই রান। টি-টোয়েন্টির মত সংক্ষিপ্ত আসরে জিম্বাবুয়ের ব্যাটাররা চুপসে গিয়েছিল মেন্ডিসের দুর্দান্ত বোলিং তোপে। মেন্ডিস যে শুধুই ইকোনোমিকাল ছিলেন তা না। উইকেট বাগিয়েছিলেন ছয় ছয়টি।

জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইনআপ একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন অজন্তা মেন্ডিস। ওপেনার ভুসিমুজি সিবান্দাকে তাঁর প্রথম শিকার বানান মেন্ডিস। তারপর একে একে উইকেট নেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, ব্রেন্ডন টেইলর, এল্টন চিগুম্বুরাদের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে অজন্তা মেন্ডিসের সেই ম্যাচের বোলিং ফিগারই এখন পর্যন্ত রয়েছে সুউঁচ্চ স্থানে।

  • রঙ্গনা হেরাথ (শ্রীলঙ্কা)

শ্রীলঙ্কা বা-হাতি অফ স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ ছিলেন তিন ফরম্যাটেই দলের জন্য বেশ কার্য্যকরী। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে রেকর্ড ছুঁয়েছেন কিংবা ভেঙ্গেছেন বহুবার। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক যেকোন ইভেন্টের রেকর্ড বইতে কে না নিজের নাম লেখাতে চায় বলুন? হেরাথও ব্যতিক্রম নয়।

২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল বাংলাদেশ। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের জহুর আমেদ স্টেডিয়ামের সুপার টেনে নিজেদের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয় হেরাথের শ্রীলঙ্কা। ট্রেন্ট বোল্ট ও জিমি নিশামের আগুন ঝড়ানো বোলিং আগে ব্যাট করা শ্রীলঙ্কাকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। ১৯.২ ওভার খেলে মাত্র ১১৯ রানেই অলআউট হয় দিলশান, জয়াবর্ধনেরা। নিউজিল্যান্ডের জন্যে তুলনামুলক সহজ টার্গেট।

তবে ম্যাককালাম, রস টেলররা হয়ত জানতেন না তাঁদের জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন অভিজ্ঞ রঙ্গনা হেরাথ। হেরাথ যেন এক মুহুর্তের জন্য ভাবেননি তাঁরা ছোট্ট টার্গেট ডিফেন্ড করছেন তাঁরা। মাত্র ৩.৩ ওভার বল করে নিউজিল্যান্ডের অর্ধেক ব্যাটারদের সাজঘরে ফেরান রঙ্গনা হেরাথ। ০.৮৫ ইকোনমি রেটে রান দিয়েছেন মাত্র তিনটি। এতেই যেন হারার শঙ্কা বদলে যায় জয়ের আশায়। শেষমেশ ৫৯ রানের বড় জয় নিয়েই ম্যাচ শেষ করেন হেরাথের শ্রীলঙ্কা।

  • উমর গুল (পাকিস্তান)

নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং লাইনআপ বরাবরই প্রশংসনীয় এবং বিধ্বংসী। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবার বিশেষ কোন জায়গা নেই। তবে নশ্বর এই পৃথিবী সবকিছুর পতন হয় কোন না কোন একদিন।  তাঁদের ব্যাটিং লাইনআপের ধ্বস নেমেছিল বহুবার এবং বেশকিছু বার তা রেকর্ডের কারণ হয়েছে। এই যেমন হেরাথের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেরা বোলিং ফিগারের সাথে জড়িয়ে আছে নিউজিল্যান্ডের নাম। ঠিক তেমনটাই ঘটেছে পাকিস্তানের পেস বোলার উমর গুলের ক্ষেত্রে।

দ্বিতীয় বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয় ২০০৯ সালে। গ্রুপ-এফ এ থাকা দুইদল পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হওয়া ছিল অবিস্বম্ভাবী। এই দুই দলের দেখা হয় ইংল্যান্ডের ওভালে। টসে জিতে ব্যাটিং এর সিধান্ত নেয় নিউজিল্যান্ড। ভালো ব্যাটিং অর্ডারের সুবিধা আদায় করাই যেন পরিকল্পনা। অপরদিকে সেই বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দল পাকিস্তানের চিন্তায় ছিল অল্প রানের মধ্যে নিউজিল্যান্ড দলকে আটকে ফেলা।

নিউজিল্যান্ডকে আটকে ফেলার দায়িত্ব একাই যেন নিজের কাঁধে তুলে নিলেন উমর গুল। দিনটাও যেন সেদিন তাঁর ছিল। ভাগ্য বিধাতাও সেদিন হয়েছিলেন সহায়। ছয় রান খরচায় গুল তুলে নেন নিউজিল্যান্ডের পাঁচটি উইকেট। তিন ওভারের বোলিং স্পেলে গুলের ইকোনমি দুই। তাঁর সেই অনবদ্য বোলিং তাণ্ডবে মাত্র ৯৯ রানেই অলআউট হয় নিউজিল্যান্ড। ১০০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৬.৫ ওভার বাকি থাকতেই ম্যাচ জিতে নেয় পাকিস্তান।

  • আহসান মালিক (নেদারল্যান্ড)

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর বড় দল গুলোর সাথে খেলার সুযোগ তেমন একটা থাকে না। বৈশ্বিক কোন টুর্নামেন্ট ছাড়া। এত কম সুযোগ পাওয়া দেশের খেলোয়াড়েরা বরাবরই নিজেদের ছাপ ফেলে রেখে যেতে চান রেকর্ডে বই এ কিংবা স্মৃতির পাতায়। নেদারল্যান্ডের আহসান মালিক পেরেছিলেন।

২০১৪ সালে ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে খেলতে নামে নেদারল্যান্ড। সবাই হয়ত ভেবেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা রান বন্যায় ভাসাবে নেদারল্যান্ডকে। কিন্তু এমনটা হতে দেননি ডাচদের ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার আহসান মালিক। দক্ষিণ আফ্রিকার রানের স্রোতে বাঁধ সাধেন মালিক।

প্রথমে ব্যাট করতে নামা প্রোটিয়াদের অর্ধেক ব্যাটারদের উইকেট নিজের পকেটে পুড়ে নেন মালিক। ডেভিড মিলার, হাশিম আমলা, অ্যালবি মরকেলদের মতো খেলোয়াড়দের উইকেট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। সে ম্যাচে তিনি রান খরচেও ছিলেন মিতব্যয়ী। মাত্র ১৯ রান দিয়ে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। প্রায় পাঁচ ইকোনমি রেটে রান খরচা করা মালিকের বোলিং এর সুবাদে ১৪৫ রানেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে আটকে ফেলে নেদারল্যান্ড। তবে জয়ের কাছে গিয়েও জয় বঞ্চিত হয় নেদারল্যান্ড। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞ বোলিং আক্রমণের সামনে লড়াই করে মাত্র ছয় রানের পরাজয় মেনে নেয় ডাচরা।

  • মুস্তাফিজুর রহমান (বাংলাদেশ)

বাংলাদেশের বিস্ময় বালক মুস্তাফিজুর রহমান, দ্য কাটার মাস্টার। ২০১৫ তে জাতীয় দলের জার্সি জড়িয়েই ২০১৬ তে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেন বা-হাতি এই পেস বোলার। অভিষেকের পর থেকেই তিনি তাঁর বিস্ময়কর বোলিং দিয়ে আলোচনয়ায় ছিলেন কিংবা ছিলেন প্রশংসায়, ভাসছিলেন বন্দনায়। প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া মুস্তাফিজ ছিলেন রোমাঞ্চিত, কিছু করে দেখাবার স্পৃহা যেন তাঁর ভেতরে জ্বালিয়েছিল আগুনের লেলীহান শিখা।

মুস্তাফিজ গেলেন ভারতে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে। চোখেমুখে স্বপ্ন, রেকর্ড গড়বার হাতছানি। রেকর্ড গড়লেন তিনি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে এক ইনিংসে সেরা বোলিং ফিগারের পঞ্চম স্থান এখন তাঁর দখলে। তাছাড়া অভিষেক বিশ্বকাপে মাত্র তিন ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট।

সেই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর অনবদ্য বোলিং তাঁকে জায়গা করে দিয়েছেন রেকর্ড বইএ। ভারতের কোলকাতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের দিনে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড। সুপার টেন পর্বের ম্যাচে আগে ব্যাটিং করার সিধান্ত নেয় নিউজিল্যান্ড। শুরুতেই মুস্তাফিজের আঘাতে হেনরি নিকলসকে হারানোর পরেও কেইন উইলিয়ামসন ও কলিন মুনরো এর ব্যাটে ঘুরে দাড়ায় নিউজিল্যান্ড।

দলের ৫৭ রানের মাথায় কেইন উইলিয়ামসন ও ৯৯ রানের সময় কলিন মুনরো আউট হয়ে গেলে তাসের ঘরের মতো পতন ঘটে নিউজিল্যান্ড ব্যাটিং অর্ডারের। রস টেলর একপ্রান্ত আগলে রেখে প্রতিরোধের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। শেষমেশ ১৪৫ রানে থামে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস।

নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং ধ্বসের অন্যতম কারিগর ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি ৫.৫০ ইকোনোমি রেটে চার ওভার বোলিং করে রান দিয়েছেন মাত্র ২২টি পক্ষান্তরে উইকেট তুলে নিয়েছেন পাঁচটি। যার অধিকাংশই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাঁর এই থাবা ফিঁকে হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতায়। ৭০ রানে অলআউট হয়ে লজ্জাজনকভাবে ম্যাচ হারে বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link