অপেক্ষার পারদ আস্তে আস্তে বাড়ছিল। এক-দুই বছর নয়, জেনারেশনের পর জেনারেশন। পশ্চিম লন্ডনের ছোট্ট একটা ক্লাবের নাম ব্রেন্টফোর্ড। লন্ডন যখন আর্সেনাল, চেলসি, টটেনহ্যামের মতন দল নিয়ে উদযাপনে ব্যস্ত। তখন ব্রেন্টফোর্ডের দর্শকেরা প্রতিবছর আশায় বুক বাঁধতেন, এবার হবে। হতো না।
ব্রেন্টফোর্ডবাসী তাও আশা ছাড়তেন না। এরিক ক্যান্টোনা বলেছিলেন, আপনি সবকিছু বদলাতে পারেন, নিজের স্ত্রী, ধর্ম, রাজনৌতিক দল; কিন্তু প্রিয় ফুটবল দল? সেটা প্রশ্নতেও আসে না। ব্রেন্টফোর্ডবাসী সেই অমর বাণী মিথ্যে করে সে সাধ্য কোথায়? তারাও দিনের পর দিন অপেক্ষার প্রহর গুনতো, সে প্রহর শেষ হতো না।
৭৪ বছরের অপেক্ষা মেটাতে এলেন থমাস ফ্র্যাংক। খেলোয়াড়ি জীবনে কিছু করতে পারেননি, কিন্তু সাইডবেঞ্চ থেকে যতটুকু করার সেটাই করেছেন।
কোভিড-পরবর্তী এই ভঙ্গুর মৌসুমে অপেক্ষাপূরণ করেছেন হাজারো ব্রেন্টফোর্ডবাসীর। ৭৪ বছর ধরে যে অপেক্ষা, ইংলিশ লিগের প্রথম ডিভিশনে খেলার, সে অপেক্ষা পূরণ করেছেন তিনি। সেই ১৯৪৭ সালে শেষবার নিজেদের লাল-সাদা দলকে দেখেছিলেন, ইংলিশ লিগের প্রথম সারিতে সম্মানের সাথে খেলতে।
এরপর ইতিহাস বদলে গেছে, সময় পাল্টেছে, চিঠির দুনিয়া থেকে ভিডিও কলে চলে এসেছে পৃথিবী, ব্রেন্টফোর্ডবাসূর আশা পূরণ হয়নি। সে আশা পূরণ করেছিলেন থমাস ফ্র্যাংক। আর প্রিমিয়ার লিগে ৫০তম দল হিসেবে অভিষেকটা রাঙ্গিয়ে রাখলেন নিজের মতন করেই।
অপেক্ষা; পৃথিবীর সবচেয়ে বেদনাবিধুর শব্দের মধ্যে উপরে সারিতেই তার অবস্থান। কিন্তু সে বেদনা মধুর হতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। তার প্রমাণ ব্রেন্টফোর্ড দিলো প্রিমিয়ার লিগ যাত্রা শুরু করতে না করতেই। ব্রেন্টফোর্ডের লড়াই ছিল লন্ডনেরই আরেক দল আর্সেনালের সাথে।
পরাক্রমশালী আর্সেনাল, গত কয়েকবছরে নিজেদের নামের সুবিচার হয়তো করতে পারেনি, তাই বলে কোনো অংশে কম যাবে না অবশ্যই। নিজেদের নতুন মাঠে আর্সেনালকে আতিথেয়তা দিলেন একদম নিজের মতন করে।
ব্রেন্টফোর্ড কমিউনিটি স্টেডিয়াম ছিল দর্শকে ভরপুর। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচ থেকেই দর্শোকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে স্টেডিয়াম। দর্শকেরা আনাগোনা, সেই সাথে ৭৪ বছরের অপেক্ষা। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল ব্রেন্টফোর্ড। আর তাদেরকেই প্রথম গোলের স্বাদ দিলেন সার্জি ক্যানোস।
৫ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে নিজের ফেরত আসাটাও রাঙিয়ে রাখলেন নিজের মতন করেই। ব্রেন্টফোর্ডের ইতিহাসে নিজের নাম লিখে রাখলেন তিনি স্বর্ণাক্ষরে।
শুরুটা ব্রেন্টফোর্ড করলেও লোকে ভেবেছিল আর্সেনাল একটু পরেই ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু নিয়মিত দুই স্ট্রাইকার অবামেয়াং ও লাকাজেটকে ছাড়া আর অভিষিক্ত তিন খেলোয়াড় নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন কোচ মিকেল আর্টেটা। জার্সির ভাড়েই মতাচটা বের করে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু মাঠে যতই বল গড়িয়েছে, ততই ম্যাচ থেকে ছিটকে গিয়েছে আর্সেনাল।
৭৩ মিনিটে পুরোপুরি ম্যাচ থেকে আর্সেনালকে ছিটকে দেন ক্রিস্টিয়ান নরগার্ড। বিশাল খরচ করে আর্সেনালের ডিফেন্স উন্নতি করে কোনো লাভের লাভই হয়নি তার প্রমাণ মিলল যেন। ব্রেন্টফোর্ড সমর্থকেরা কিন্তু আতিথেয়তা দিতে ভুল করেননি। ইউরোতে পেনাল্টি মিস করে সকলের কাছ থেকে দুয়ো শুনতে হয়েছিল যে বুকায়ো সাকাকে, তাকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানায় তাঁরা।
ব্রেন্টফোর্ডের বেশ অদ্ভুত একটা ডাকনাম আছে, ‘দ্যা বিস’, অর্থাৎ মৌমাছির দল। এর পেছনেও মজার একটা গল্প আছে। তাদের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম দিকে স্কোরবোর্ডে তাদের নাম লেখা হতো ‘The Bs’ নামে। কয়েকজন কলেজ সমর্থক তাদের সমর্থনের জন্য চিৎকার করতে থাকে ‘Buck up Bs’ কিন্তু পত্রিকার লোকেরা তাকে লিখে বসে ‘Buck up Bees’ হিসেবে। ভুল থেকে মৌমাছির দল হয়ে উঠা ব্রেন্টফোর্ড প্রিমিয়ার লিগের প্রথম হুল ফোটালো আর্সেনালের গায়ে।
৭৪ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে আসা, পাওয়া জয়ের স্বাদ, ১৭ হাজার উপস্তিত দর্শোক আর বাইরে থাকা জাগারো মানুষের চিৎকারে একাকার হয়ে গিয়েছিল পশ্চিম ব্রেন্টফোর্ড। ফুটবলকে কী আর এমনি এমনি চূড়ায় স্থান দেওয়া হয়?
প্রিমিয়ার লিগকে বলা হয় স্বপ্নপূরণের জায়গা। নাম না জানা খেলোয়াড়েরাও রথী-মহারথী হয়ে গিয়েছেন এখানে এসে, সেই প্রিমিয়ার লিগের নতুন মৌসুমের সূচনা নতুন এক দলের স্বপ্নপূরণ দিয়ে। এর থেকে ভালো শুরু আর কীসে হতে পারতো?