সর্বকালের সেরা দুর্ভাগা ক্রিকেটার

শেষ অবধি পৃথিবীর জটিলতা আর সহ্য করতে পারেননি ফকনার৷ তার যুগের সেরা অলরাউন্ডার অব্রে ফকনার তার অ্যাকাডেমির এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে গ্যাস প্রয়োগ করে আত্মহনন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৮, অথচ মাত্র ছয় বছর আগেই খেলেছিলেন শেষ টেস্ট। সুইসাইড নোটে তিনি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখে যান, ‘Dear McKenzie, I am off to another sphere via the small bat-drying room. Better call in a policemen to do investigating.’

মতি নন্দীর লেখা ‘বুড়ো ঘোড়া’ উপন্যাসটা পড়ছিলাম। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জহর পাল, একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রথম বিভাগের ক্রিকেটার। কলকাতার একটা টুর্নামেন্টের ফাইনালে তার নেতৃত্বে মোটামুটি খর্বশক্তির দল খেলবে মৌসুমের সবচাইতে শক্তিশালী দলের বিপক্ষে। সতীর্থদের উদ্দীপ্ত করার জন্য প্রবীণ জহর পাল একটা ম্যাচের উদাহরণ দিয়েছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের কথা। নিজেদের মাটিতে ইংল্যান্ডকে ৫-০ ব্যবধানে উড়িয়ে দিয়েছে ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের অস্ট্রেলিয়া। এরপর ফিরতি সফরে ইংল্যান্ডে গিয়েও তিন ম্যাচ শেষে এগিয়ে গেছে ৩-০ তে৷ টেস্ট, প্রথম শ্রেণি ও অন্যান্য – সব মিলিয়ে টানা ৩৪ ম্যাচে অপরাজিত আর্মস্ট্রংয়ের সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া।

সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক আর্চি ম্যাকলারেন হঠাৎ ঘোষণা দিলেন যে আর্মস্ট্রংয়ের অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর টোটকা তার জানা আছে। ম্যাকলারেন বললেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলে আর কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটারের সমন্বয়ে দল গড়ে হারাবেন অজিদের।

স্বভাবতই লোকজন হেসে উড়িয়ে দিল। এও কী সম্ভব নাকি!

এমনকি ম্যাচটা কাভার করতে একজন বাদে কোনো সাংবাদিকও আসেননি। যিনি এসেছিলেন, তিনি হলেন নেভিল কার্ডাস। স্বয়ং আর্চি ম্যাকলারেন তাকে পত্রযোগে আসতে অনুরোধ করেছিলেন।

ম্যাকলারেনের একাদশে ছিলেন ৩৯ বছর বয়সী দক্ষিণ আফ্রিকার এক ক্রিকেটার। ক্রিকেট খেলার জন্য যে ফিটনেস প্রয়োজন তার বালাই নেই। দু-দুটো যুদ্ধে গেছেন, ম্যালেরিয়ার সঙ্গে লড়েছেন এবং সবচেয়ে বড় কথা- গত নয় বছরে একটা টেস্টও খেলেননি।

অব্রে ফকনারের কথা বলছি।

যাই হোক, ম্যাকলারেনের একাদশ প্রথম ইনিংসে বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। ৪৩ রানেই অলআউট। বুড়ো অব্রে ফকনার ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমেই আউট, স্টাম্প উপড়ে ফেলেছেন অজি অধিনায়ক আর্মস্ট্রং।

নয় উইকেট হাতে রেখেই ম্যাকলারেন একাদশের রান পেরিয়ে যায় অজিরা, তবে অলআউট হয় ১৭৪ রানে। লেগস্পিন করে ফকনার অবশ্য কিছুটা ফর্ম ফিরে পেয়ে নেন অজিদের চার উইকেট।

এবার অবশ্য শুরুতেই নামলেন না ফকনার। যখন নামলেন, তখনও অবশ্য খুব স্বস্তিতে নেই তাঁর দল। চার উইকেট পড়ে গেছে, অজিদের আরেকবার ব্যাট করাতে বাকি ৭১ রান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা আর কত সামলাতে পারবে অজিদের!

নেভিল কার্ডাসও ভাবলেন, ‘ওদের গো-হারা দেখে কী করব? তার চেয়ে বরং লন্ডনে ফিরে যাই।’

কিন্তু কার্ডাস যাননি, ভাবলেন আর কিছুক্ষণ দেখেই যাই।

হয়ত সেদিন আগে-ভাগে চলে গেলে অনেকদিন আফসোস করতে হত তাকে। কারণ, নয় বছর ধরে টেস্ট না খেলা অব্রে ফকনার ব্যাট হাতে আর্থার মেইলি, জ্যাক গ্রেগরি, টেড ম্যাকডোনাল্ড, ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংদের একহাত নিয়ে খেললেন ১৫৩ রানের প্রায় নিখুঁত ইনিংস।

প্রথম ইনিংসের চার উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসেও নিলেন দুই উইকেট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটা – অধিনায়ক আর্মস্ট্রংকে আউট করলেন ফকনার। মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়ার জয়রথ থামিয়ে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সেরা ক্রিকেটার অব্রে ফকনার।

১৯১০-১১ এর অস্ট্রেলিয়া সফর তাঁর ব্যাটিংয়ের জন্যে বিখ্যাত৷ ৫ টেস্টে ৭৩ গড়ে ফকনার করেন ৭৩২ রান ও লেগস্পিন করে নেন ১০ উইকেট৷ দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সিরিজ রেকর্ড হিসেবে এই রেকর্ড এখনও অক্ষুণ্ণ। এক সিরিজে ৭০০ রান পেরিয়ে যাওয়া প্রথম ক্রিকেটারও তিনি।

২৫ টেস্টে ৪১ গড়ে ১৭৫৪ রান ও ২৬ গড়ে ৮২ উইকেট নেন তিনি। ১১৮ প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সাড়ে ৩৬ গড়ে ৬৩৩৬ রান ও ১৭ গড়ে ৪৪৯ উইকেট নেন এই অলরাউন্ডার।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দ্বিশতক করার রেকর্ডও তাঁর দখলে।

পেশাদার ক্রিকেটে তার দুর্দান্ত সাফল্য অনেকটাই আড়াল করে দিয়েছিল তাঁর সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিজীবনকে।

ছোটবেলায় একবার বাড়ি ফিরে এসে ফকনার মদ্যপ বাবাকে পেলেন তাঁর মাকে প্রহার করা অবস্থায়। বেশ ধনী ছিলেন তার বাবা৷ কিন্তু ছিলেন মদ্যপ আর ফকনারের মাকে প্রায়ই অত্যাচার সইতে হত।

এই দৃশ্য আগেও দেখেছেন ফকনার। কিন্তু এবার আর রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলেন না৷ যতক্ষণ পর্যন্ত তার বাবা খোঁড়া না হচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁকে মেরেই গেলেন ফকনার৷ এরপর বাসা থেকে সেই যে বেরোলেন, আর ফেরেননি।

সেই স্মৃতিটা বারবার তাড়িয়ে বেড়াত ফকনারকে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও সুখী ছিলেন না৷ প্রথম বিয়েটা টেকেনি। দ্বিতীয়বার তুলনামূলক কমবয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করলেন ১৯২৮ সালে, যে তাঁর ক্রিকেট অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি ছিল।

কিন্তু আর্থিকভাবে খুব সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়া ফকনার ধীরে ধীরে মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আশপাশের মানুষজনের সন্দেহ হয়েছিল যে ফকনার বাইপোলার ডিজঅর্ডার অথবা ম্যানিক ডিপ্রেশনে ভুগছেন।

শেষ অবধি পৃথিবীর জটিলতা আর সহ্য করতে পারেননি ফকনার৷ তার যুগের সেরা অলরাউন্ডার অব্রে ফকনার তার অ্যাকাডেমির এক রুদ্ধদ্বার কক্ষে গ্যাস প্রয়োগ করে আত্মহনন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৮, অথচ মাত্র ছয় বছর আগেই খেলেছিলেন শেষ টেস্ট।

সুইসাইড নোটে তিনি তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখে যান, ‘Dear McKenzie, I am off to another sphere via the small bat-drying room. Better call in a policemen to do investigating.’

অন্যতম সেরা ক্রিকেট-মস্তিষ্কের অধিকারী অব্রে ফকনারের স্ত্রীও ততদিনে আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। মারা যাওয়ার সময় কেবল ৩০০ পাউন্ডের একটা জমি রেখে গিয়েছিলেন ফকনার।

গল্পগুলো কেন এভাবে শেষ হয়?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...