ভারতপ্রাচীর ও অজি ডিনামাইট!

পাকিস্তান সফরেই বিষয়টা লক্ষ্য করেছিলেন স্টিভ ওয়াহ। অদ্ভুত গতি। যেন লালবলটা ড্রপ খাবার পর একটা ছিটকে বেরোনো বিদ্যুতের মতো ধেয়ে আসে ব্যাটসম্যানের দিকে। আউটসুইং-এ বেশি কাটে ঠিকই, ব্যাটসম্যান যদি চালাক হয় তবে অনায়াসে ছেড়ে দেবে কিন্তু ইনসুইং?

এ ছেলের আগুনে ইনসুইং যদি একটু লম্বা লেংথে পড়ে তবে ব্যাট নামানোর আগেই প্যাড কিংবা উইকেটে আছড়াবে নিশ্চিত- আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষাও করতে হবে না আর। খাঁটি সোনা জহুরির চোখ দিয়ে চিনতে ভুল করেন নি স্টিভ, কিন্তু অভিষেক করানো গেল না কিছুতেই।

গ্লেন ম্যাকগ্রা আর ফ্লেমিং-এর মাঝে নিউ সাউথ ওয়েলসের ছেলেটাকে জায়গা দেওয়াও দুস্কর। নিজের রাজপাটে অভিষেকের জন্য একটা মঞ্চের দরকার ছিল তার, সেটা স্টিভ তাকে দিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই। দ্বিতীয় টেস্টে তরুন বারুদ ব্রেট লি-র সামনে এল সেই সুযোগ। ভারতীয় ব্যাটিংয়ে তখন ভিভিএস লক্ষ্মণ-রাহুল দ্রাবিড়-শচীন টেন্ডুলকার-সৌরভ গাঙ্গুলির চতুস্তরীয় নিরাপত্তা বলয়।

স্টিভ জানতেন অস্ট্রেলিয়ার পিচে ম্যাকগ্রা তাঁর তুরুপের তাস হলেও ম্যাকগ্রা আর ফ্লেমিং-এর গতির থেকে অনেকটা বেশি গতির এক ফার্স্ট চেঞ্জ বোলার আনলে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে ভারতের মিডল অর্ডারটাকেও। ব্রেট লি-সেই তুরুপের তাস হয়েই এলেন তাঁর হাতে। কিন্তু দ্রাবিড় তখন ভারতীয় ব্যাটিংয়ের অদৃশ্য মেরুদণ্ড।

ডারবানের ওই আগুনে পিচে মাটি কামড়ানো ২৭, ওয়ান্ডারার্সের বিস্ময় হয়ে থাকা ১৪৮ কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজে পরপর চারটে হাফ সেঞ্চুরি ও ৭২ ব্যাটিং গড় তখন ক্রিকেট বিশ্লেষকদের কাছে এক গবেষণাপত্র, তার পরতে পরতে দ্রাবিড় প্রমাণ করে দিয়েছেন বিদেশের মাটিতে ভারতের জন্য নিজের প্রাণটুকু স্টাম্পের মতোই যত্ন করে সাজিয়ে মাঠে নামেন তিনি। একটার পর একটা গোলা বারুদ শুষে নেয় তাঁর শীর্ণকায় দেহ।

আউটসাইড এজ। আউট! সোনালি চুলের লি তখন উদ্দামতার ডিনামাইট হয়ে যেন ফাটল ধরালেন ভারতের দেওয়ালে। নিজের জীবনের প্রথম স্পেলেই দ্রাবিড়কে তুলে নিয়ে যেন এক সভ্যতার আদিম বিশ্বাসে আঘাত হানলেন লি। দ্রাবিড় নিজেকে একটু গুছিয়ে নেবার আগেই দ্বিতীয় ইনিংসে আবার আউট।

আবার গিলির বিশ্বস্ত হাতে জমা পড়ল দ্রাবিড়ের ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়া লি-র গোলা। দ্রাবিড়ের সামনে সেই উচ্ছ্বাস যেন প্রতিষ্ঠা করল এক দীর্ঘ লড়াই-এর রণক্ষেত্র। ৯ আর ১৪- রানদুটো নিঃশব্দেই নিজের ভেতর রেকর্ড করে রাখলেন দ্রাবিড়। আর লি? ডেবিউ টেস্টে ৫ উইকেট নিয়ে ছুঁয়ে দিলেন তাঁরই দেশের কিংবদন্তী ডেনিস লিলিকে।

মেলবোর্নের পর সিডনিতেও লি’র গোলার মুখে পড়লেন দ্রাবিড়। কিন্তু এবার নিজের ঈশ্বরপ্রদত্ত স্থৈর্য দিয়ে লি-কে যেন একটু পড়ে ফেললেন দ্রাবিড়। গতি নয় বরং বল পিচে পড়ার পর যে স্মুথ স্কিড বা পিচ্ছিলতার জন্য নিমেষে পাল্টে যায় লি-র বলের ব্যকরণ তা বুঝতে দেরী হল না দ্রাবিড়ের। তাই এই টেস্টে অদৃশ্য লড়াই-এর আগুন চেয়েও জ্বালতে পারলেন না লি। কিন্তু দ্রাবিড় জানতেন, দেওয়ালে বুকে এঁকে দেওয়া ক্ষতচিহ্নের কাছে একদিন না একদিন ফিরতেই হবে এই তরুণ প্রতিভাকে।

২০০০-০১ এর ভারতসফরে এলেন না লি। দ্রাবিড়ের ঐতিহাসিক ইডেনটেস্টের পরেও পুরোনো বদলাটা বাকি থেকে গেল যে। ২০০৩-০৪। স্টিভের বিদায়ী সিরিজ। লি শুরু থেকে চোটের কবলে। ফিরলেন তৃতীয় টেস্টে। তার আগেই এডিলেডে স্টিভ আর অজি মিডিয়াকে নিজের নীরব ঔদ্ধত্য দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছেন দ্রাবিড়।

মেলবোর্নে ফিরলেন লি। সেই মেলবোর্ন যেখানে অঙ্কটা অসমাপ্ত রেখে ফিরেছিলেন দ্রাবিড়। আগুনে মেজাজে লি ফিরলেন। কিন্তু দ্রাবিড় যেন অবিচল, অনড়, নিজের লক্ষ্যের কাছে এ যেন এক আশ্চর্য প্রতিজ্ঞা তাঁর। বল ড্রপ খাবার পর দ্রুত ইনসুইং হলে লেগগ্লান্সে শাফল করার দ্রুততা বাড়াতে নেটে বিশেষ অনুশীলন করেন দ্রাবিড়।

এই ছিল ভারতের কর্ণের একাগ্র সাধনা। লি-র এই প্রত্যাবর্তনের পর দ্রাবিড়ের উইকেট তোলার জন্য ক্রমাগত পাল্টালেন নিজের লেংথ, আউট আর ইনসুইং-এর দোলাচল দ্রাবিড় সামলালেন, সৌরভের মাথা লক্ষ্য করে খুলি ফাটিয়ে দেওয়া বিষাক্ত বাউন্সারটা ভারতের দেওয়ালে শেষ ব্রহ্মাস্ত্রের মতো দিতে শুরু করলেন লি, কিন্তু ততক্ষণে ভারতপ্রাচীরে এসে পাংচার হয়ে গেছে ২৪৪ টি অজি বুলেট। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ৯২(২৪৪), তবু কি অদ্ভুত, দ্রাবিড় নিধন হলও শেষ অবধি সেই লি-এরই হাতে!

কিন্তু ভুলটা ফের করলেন লি। ক্রমশ দেওয়াল হয়ে ওঠা দ্রাবিড় নিজেকে আরও মেরামতি করে আরও কঠিন হয়ে উঠলেন সিডনিতে। লি-এর আত্মমর্যাদার আগুন যত থমকাল দেওয়ালে ততই গর্জে উঠল তাঁর অজি রক্ত। এই রক্তের বদলায় রক্তের হিসেব তিনি মেটালেন ডনের খাসতালুকে।

ক্রমাগত ব্যাক টু ব্যাক ওভারে ১১ টি বাউন্সারের পর নিজের সর্বশেষ শক্তি দিয়ে ছোঁড়া গোলাটা সপাটে আছড়াল দ্রাবিড়ের হেলমেটের নীচে, কানের পাশ থেকে ঝরছে রক্ত- লি ভেবেছিলেন হয়ত সৌরভের মতোই পাল্টা গলা চড়াবেন দ্রাবিড়- কিন্তু লি তখনও জানতেন না আগ্রাসনের সমস্ত আগুন যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু এক আদিম সভ্যতা, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা, যার শান্ত উপস্থিতির কাছে নত হন সমস্ত রথী-মহারথী!

জীবনের এই বাইশগজে লড়াইটা আজ যেন হালকা হয়ে গেছে অনেক। দ্রাবিড় চিরকালীন জ্যোতস্নার মতো আজও শান্ত, লি-এর ঔদ্ধত্যে বিনয় এনেছে সময়। দুজনে মুখোমুখি হলে এখনো যেন একটু উষ্ণ হয়ে ওঠে চারপাশ। পরিসংখ্যান বলছে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্ন জমানাতেও দ্রাবিড়ের উইকেট সবচেয়ে বেশিবার নিয়েছেন সেদিনের নিউ সাউথ ওয়েলসের তরুণ ব্রেট লি, টেস্টে ১২ বার সাক্ষাতে ৫ বারই লি-র হাতে ফাটল ধরেছে ভারতের দেওয়ালে, আবার অস্ট্রেলিয়ার পিচে লি-র ৩৮৪ টা বল থমকে গেছে ভারতের দেওয়ালে, লি-র বিপক্ষে সিডনি, মেলবোর্ণে ৯১,৯২ রানের ইনিংস খেলেছেন দ্রাবিড়, সাদাবলের ক্রিকেটেও লির সামনে দ্রাবিড় এলে জমে উঠেছে লড়াই।

কিন্তু, দ্রাবিড় আর লি-লড়াইয়ের আসল রসায়ন হয়ত এখানেই যে দুই ভিন্ন মেরুর, ভিন্ন দর্শনের ক্রিকেট জিনিয়াস বাইশ গজের দুপাশে দাঁড়িয়ে যেমন লড়েছেন তেমনই হয়ে উঠেছেন বন্ধুও। লি বলেন, ‘আপনি যদি দ্রাবিড়ের সাথে পেরে উঠতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে জীবনে আপনি খুব বিপদে আছেন।’

সত্যিই হয়ত তাই। দ্রাবিড়ের নিজস্ব সাম্রাজ্যে কিছুটা ক্ষত হয়েই ছিলেন এই তরুণ। তবু তিনি দ্রাবিড়, নির্দ্বিধায় বলে দেন- লি অনবদ্য প্রতিভা, আমি দেশের জন্য আমার ধর্ম পালন করি মাত্র। এমনিতে আমরা বন্ধুই!

এই ধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থ হয় না, মহাকাব্যের পাতায় অনেকটা জুড়ে থেকে যায় এই লড়াই-এর আঁচ। দ্রাবিড়কে যেমন ভারতের জন্য খালি পায়ে কাচের ওপর দিয়ে হাঁটতে বললে তিনি উত্তর দেবেন- ‘কত মাইল?’, লি-ও তেমনি ব্যাগি গ্রিন ক্যাপটার জন্য দিয়ে দিতে পারেন নিজের সবটুকু প্রতিভা।

একুশ শতকের গোড়ায় ম্যাকগ্রা-শচীন রূপকথার পাশে আগ্রাসন আর স্থৈর্যের অনন্ত এক লড়াই দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব, ভারতপ্রাচীরে একটুকরো দাগ হয়ে থেকে যাওয়া সেই অজি ডিনামাইট, যার রোমাঞ্চের কাছে ফিরতে হবেই উত্তরপ্রজন্মকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link