ভয় ভয় লাগছে বেশ, ভালভাবেই ভেতরের কাঁপুনিটা টের পাচ্ছি, মনে হচ্ছে এই বলটাই হয়তো আমাকে ভেঙেচুরে চ্ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে যাবে।
বোলার প্রস্তুত, প্রস্তুত ব্যাটসম্যান। দৌড় শুরু করলো বোলার।
আসছে! আসছে! শর্ট লেন্থে পিচ করে বলটি ধেয়ে আসছে প্রচণ্ড গতিতে, ব্যাটসম্যান রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাটটা মাথার উপর দিয়ে সরিয়ে নিল, বল বাতাসে হালকা ইনসুইং করে অফস্ট্যাম্পের কিছুটা উপর দিয়ে চলে গেল কিপারের গ্লাভসে।
বোলারকে হতাশ করে বেঁচে গেলাম এবারের মত! অপেক্ষা পরের বলের।
আমি স্ট্যাম্প। ক্রিকেট খেলার অন্যতম প্রধান উপকরণ।
ক্রিকেট খেলায় সবচেয়ে সাহসী বস্তু মনে হয় আমিই! একটা জিনিসকে আক্রমণ করতে এতগুলো মানুষ হামলে পড়লেও তাদের সামনে একজায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে কি পরিমাণ সাহস লাগে বুঝুন দেখি!
এতগুলো মানুষের সব আক্রোশ যেন আমারই উপর। ওদের যেন মায়াদয়াও হয়না এই অসহায় তিনটি দণ্ডকে এভাবে ভাঙতে!
ক্রিকেট খেলায় একজন ফাস্ট বোলারের জন্য অন্যতম সুন্দর দৃশ্য, স্ট্যাম্প উপড়ে গিয়ে মাটিতে ডিগবাজি খাওয়া!! আর ভূপতিত স্ট্যাম্প পর্যন্ত প্রসারিত ব্যাটসম্যানের অসহায় দৃষ্টি।
এই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটাতেই আমরা দেখি বোলারদের একের পর এক টেকনিক, গতির সম্ভ্রম, ঘূর্ণির জাদু, মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, নিখুঁত পরিকল্পনা।
যুগে যুগে ভয়াল বোলার এসেছে, দানব এসেছে আর আমি চোখ বন্ধ করেছি, সে শান্তিও দিলো না মানবসমাজ, মিডল স্ট্যাম্পে সেট করে দিলো ক্যামেরা! ক্যামেরাতে বল ছুটে আসা দেখতে মানুষ খুব আহ্লাদ অনুভব করলেও আমার অবস্থা যদি ওরা বুঝতো!
ওরা দৌড় শুরু করলে আমার কাঁপাকাপি শুরু হয়, ভাগ্যিস স্ট্যাম্পদের মানুষের মত টয়লেট পায়না, নয়তো পিচ হয়তো আমিই নষ্ট করে দিতাম, তবে মাঝেমাঝে অবস্থা হয়ে যায় নট নড়ন চড়ন! ২০০৫ সালে আশরাফুল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই সুযোগ নিয়ে যে মার মেরেছে, সারাজীবন মনে রাখবে ওই পেসার।
এই নট নড়নচড়ন দশার জন্য ক্রিকেট ইতিহাসে স্ট্যাম্পে লেগেও বল না পড়ার ঘটনা আছে বহুবার।
পাকিস্তানি বোলারগুলোকে আমি দেখতে পারিনা একদমই। সবচেয়ে বেশি বোল্ড করার কীর্তিতো তাদেরই, বিশেষ করে ওয়াসিম আকরাম (২৭৮), ওয়াকার ইউনুস (২৫৩) এরা যেন ছিল একেকটা ছিল যমদূত, তবে এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে একজন, সে আবার পেসারও না, স্পিনার, যার চোখ দেখেই পারলে আমি মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে যাই, আর ডেলিভারিগুলো! ওরে বাবারে! ওগুলো খেলতে হিমশিম খাওয়া বেচারা ব্যাটসম্যানের জন্য খারাপই লাগত, ব্যাটার নাম মুত্তিয়া মুরালিধরন, ২৯০ বার আমাকে ভেঙেছে, মেরেছে, আছড়েছে, গুঁড়িয়েছে।
আহ! কি ভয়াল দিনগুলিই না গেছে!
সেযুগের বোলারগুলোর কাছে আমাকে ভাঙার এই প্যাশন ছিল অনেকটা পরাক্রম দেখানোর মত, আর ব্যাটসম্যানের জন্য চরম লজ্জার। তাই বোলাররা ডাইরেক্ট বোল্ড করে আউট করতে না পারলে শান্তি পেত না।
এখনকার বোলাররা এতটা প্যাশনেট নন, কোনমতে ক্যাচ তুলিয়ে বা লেগবিফোরের ফাঁদে ফেলে উইকেট পেলেই তাদের হয়। তবে এখনকার বোলাররা তাই বলে কম জ্বালাচ্ছে না! বর্তমান পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ বোল্ড এর মাধ্যমে উইকেট নেয়া মিচেল স্টার্ক(১১৭) আর স্পিনারদের মধ্যে ওই বাঙাল ছোঁড়া সাকিব আল হাসান (৯৯) সবচেয়ে বেশি বোল্ড করে আমাকে ক্রমাগত ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে।
আর একদম নতুনদের মধ্যে আরেক বাঙাল বিচ্ছু মুস্তাফিজুর, পিচ্চি রশিদ কিংবা কিউই বোল্ট এরা এলে আমি একদমই অনিরাপদবোধ করি।
শোনা যায় এককালে ক্রিকেট খেলায় স্ট্যাম্প বলতে কিছু ছিল না। ব্যাটসম্যানরা ইচ্ছেমত ব্যাট করত, শুধু উড়িয়ে মারলে ক্যাচ উঠালেই আউট হত। এতে দেখা যেত ব্যাটসম্যানরা একটু ডিফেন্সিভ স্ট্রাটেজি নিলেই অন্যরা ব্যাটই পেত না। তাই চিন্তাভাবনা শুরু হয় ব্যাটসম্যানের স্বাধীনতা একটু কমিয়ে দেয়ার। তাই নিয়ম হয় ব্যাটসম্যানের পেছনে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে দুটি লাঠি থাকবে, এর মধ্য দিয়ে বল গেলে ব্যাটসম্যান আউট। সেখান থেকেই বোলিং যেন নতুন আর্টে পরিণত হলো।
এরপর ১৭ শতকের শেষভাগে স্ট্যাম্পের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য গৃহীত হয়। মিডল স্ট্যাম্পকে যোগ করে তিনটি স্ট্যাম্প ক্রিকেট খেলায় যুক্ত করা হয়। সেখান থেকেই ডেভেলপড হয়ে আজকের এলইডি স্ট্যাম্প পর্যন্ত দেখা যায়, যেই স্ট্যাম্পের লেন্থ হয় ২৮ ইঞ্চি, এবং বেলের লেন্থ হয় ২ ইঞ্চি।
তবে পাড়ার ক্রিকেটে এই লেন্থ-টেন্থ মানতে লোকের বয়েই গেছে! কখনো কখনো ৪-৫ ইট দিয়ে সাজিয়ে তোলা উঁচু ঢিবিটাই হয়ে যায় স্ট্যাম্প, আবার কখনো কখনো কয়েকটি স্কুলব্যাগের সমাহারই স্ট্যাম্প হিসেবে গণ্য হতে থাকে। অর্থাৎ ক্রিকেট খেলতে আর যাই লাগুক, স্ট্যাম্প লাগছেই, আমি ছাড়া ক্রিকেট অচল।
জীবনের ছোট্ট একটি দর্শন যেন এর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুটিত হয়। মানুষভেদে লক্ষ্যটা হয়তো আলাদা হয়, সবার লক্ষ্যটা একরকম হয়না। তবু সেই লক্ষ্যভেদেই মানুষের চরম প্রাপ্তি, লক্ষ্য ছাড়া জীবনটাও অচল। স্ট্যাম্প ছাড়া যেমন ক্রিকেট কল্পনা করা যায়না, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া জীবনটাও ছন্নছাড়া।
তিনটি লাঠির সাথে জড়িয়ে থাকা এত এত মানুষের এত এত কীর্তি, এত এত কান্না, এত এত ভালবাসা, এত এত চোয়ালবদ্ধ দৃঢ়তা আমাকে গর্বিত করে, আপ্লুত করে, অনুপ্রেরণা দেয় পরের ম্যাচে আরো এক গতিময় ফাস্ট বোলারের মুখোমুখি হতে।
শুধু একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকে না, আমার পেছনে যারা দাঁড়ায় তাঁদের উইকেটরক্ষক কেন বলে? ছোকড়াগুলোতো সুযোগ পেলেই আমাকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদের নাম তো আসলে ‘উইকেটভঙ্গক’ জাতীয় কিছু হওয়া উচিৎ!