Social Media

Light
Dark

ডেভিড জনসন, ভারতের হারিয়ে যাওয়া গতি তারকা

তাঁর নাম শুনে ভারতীয় বলে বিশ্বাস হয় না , বরং অস্ট্রেলিয়ান কিংবা ইংরেজ বলেই ভ্রম হয়। অথচ তিনি ছিলেন ভারতের গতি তারকা, ক্যারিয়ারে কখনও গতির সাথে আপস করেননি। স্লিঙ্গিং অ্যাকশনে গতির ঝড় তুলে কাঁপুনি ধরিয়েছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের। জাতীয় দলে খুব বেশি সুযোগ না পেলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপিয়ে খেলেছেন। তিনি ডেভিড জনসন, ভারতের হারিয়ে যাওয়া এক গতি তারকা। 

জনসনের ক্রিকেটের শুরুটা কর্ণাটকের হয়ে বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে। অনূর্ধ্ব- ১৯ দলের হয়ে নিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ১৩ উইকেট নিয়ে আলোচনা ছড়ান ক্রিকেট আঙিনায়। কিন্তু সে সময়টাতে কর্ণাটকের মূল দলের পেস বোলিং লাইন আপের নেতৃত্ব ছিল কিংবদন্তি জাভাগাল শ্রীনাথের হাতে। তাই রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেকের আগে অপেক্ষা করতে হয় জনসনকে। 

অবশেষে জাতীয় দলের জন্য শ্রীনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লে ২১ বছর বয়সে রঞ্জিতে গোয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয় তাঁর। সে ম্যাচে দুই উইকেট নিয়ে তেমন আলো ছড়াতে না পারলেও পরের মৌসুমে আরো পরিণত হয়ে ফিরে আসেন। আসামের বিপক্ষে সাত উইকেট নিয়ে একাই গুঁড়িয়ে দেন আসামকে। বাংলা এবং বারোদার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে আগুন ঝরান পাঁচ উইকেট নিয়ে।

সেবার ভারত সফরে এসেছিল রিকি অস্ট্রেলিয়া। দারুণ ফর্মে থাকার সুবাদে সফরকারীদের বিপক্ষে আয়োজিত প্রস্তুতি ম্যাচে প্রেসিডেন্ট একাদশের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান তিনি। নতুন বলে ডোড্ডা গনেশের সাথে জুটি বেঁধে সে ম্যাচে অজিদের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়েন। রিকি পন্টিং আর মাইকেল স্ল্যাটারের উইকেট নিয়ে জাতীয় দলে ঢোকার দাবিটা আরও জোরালো করেন তিনি।  

ভাগ্যবিধাতাও যেন চাইছিলেন অজিদের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে তাঁর। নইলে ম্যাচের আগে কেনই বাঁ চোটে পড়বেন শ্রীনাথ আর তাঁর পরিবর্তে দলে ঢুকবেন জনসন। কোটলার স্পিননির্ভর পিচে প্রসাদের সাথে জুটি বেঁধে নতুন বলে বোলিং শুরু করেন অভিষিক্ত জনসন।

কিন্তু, মাত্র চার ওভার পরেই আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেয়া হয় তাঁকে, দায়িত্ব বুঝে নেন চিরায়ত ভারতীয় স্পিনাররা। অনিল কুম্বলে, সুনীল যোশি, আশিষ কাপুরের তোপে পড়ে অজিরা গুটিয়ে যায় ১৮২ রানেই। জবাব দিতে নেমে নয়ন মঙ্গিয়ার অনবদ্য ১৫২ রানের ইনিংসের সুবাদে প্রথম ইনিংসে ১৭৯ রানের বিশাল লিড পায় স্বাগতিকরা।

দশ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে রানের খাতা না খুলে অপরাজিত ছিলেন জনসন। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেটের জন্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। প্রথম ওভারেই উইকেটের অনেক বাইরের একটু বল ড্রাইভ করতে গিয়েছিলেন অজি ওপেনার মাইকেল স্ল্যাটার।

কিন্তু, বল ব্যাটের কানায় লেগে ক্যাচ উঠলে দারুণ রিফ্লেক্সে এক হাতে বল তালু-বন্দি  করেন মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন। ফলে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট উইকেটের স্বাদ পান জনসন। পরে দারুণ এক বাউন্সারে কাবু করেছিলেন রিকি পন্টিংকেও, কিন্তু আম্পায়ার সাড়া না দেওয়ায় সে যাত্রায় উইকেট বঞ্চিত হন তিনি।

পরের সিরিজেই শ্রীনাথ ইনজুরি থেকে সেরে ওঠায় দল থেকে বাদ পরেন জনসন। তবে এক সিরিজ বাদেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দলে ফিরে আসেন। মূলর মাঝের সময়টাতে দারুণ পারফর্ম করে বাধ্য করেছিলেন পুনরায় দলে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে ইস্টার্ন প্রভিন্সের বিপক্ষে কেপলার ওয়েসেলস বেধড়ক পিটিয়েছিলেন তাঁকে, ১৯ ওভারে ৮৮ রান দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় কেবল অ্যাশওয়েল প্রিন্সের উইকেট নিয়েই।

তবে কিংস মিডে প্রথম টেস্টে অবশ্য একেবারে খারাপ করেননি, পুরো পেস ইউনিটই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিল দারুণভাবে। প্রসাদ দশ উইকেট পেয়েছিলেন, তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন শ্রীনাথ। শুরুতে হার্শেল গিবসকে ফিরিয়ে নিজের দায়িত্বটাও সূচারুরূপে পালন করেছিলেন জনসন। পরে ফিরিয়েছেন ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে ওঠা ব্রায়ান ম্যাকমিলানকেও। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসে কোনো উইকেট পাননি। পরের টেস্টে তাঁর জায়গায় দলে আসেন ডোড্ডা গণেশ। ভারতের হয়ে আর কখনোই মাঠে নামা হয়নি জনসনের। ফলশ্রুতিতে মাত্র দুই টেস্টেই শেষ হয়ে যায় তাঁর ক্যারিয়ার। 

আসলে ক্যারিয়ার শেষ হবার পেছনে ভাগ্যকে দোষারোপ করতে পারেন জনসন। তাঁর অভিষেক হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে, মুখোমুখি হতে হয়েছে বিশ্বসেরা সব ব্যাটসম্যানের। নিজেকে প্রমাণের খুব বেশি সুযোগ পাননি। তাছাড়া ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর আগমণের সময়টাতে ভারতের হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন জাভাগাল শ্রীনাথ, ভেঙ্কটেস প্রসাদ, ডোড্ডা গণেশের মতো পেসাররা।

চিরকালই স্পিননির্ভর দল সাজানো ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না চার পেসার খেলানোর বিলাসিতা করার। তাছাড়া গতির উপর বেশি মনোযোগ থাকায় লাইন-লেন্থটা কখনোই টেস্ট বোলার সুলভ ছিল না জনসনের। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অনেকেই তাঁকে গতি কমিয়ে বল নিয়ন্ত্রণে মনোযোগ দিতে বলেছেন, কিন্তু গতির সাথে কখনোই আপোষ করেননি তিনি। গতি ছিল তাঁর স্বকীয়তা, নিজের স্বতন্ত্র এই বৈশিষ্ট্য তিনি হারাতে চাননি। 

জাতীয় দলে না খেললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই ছিলেন জনসন। নিজের প্রথম ম্যাচের মত শেষ ম্যাচটাও খেলেছিলেন গোয়ার বিপক্ষে। সে ম্যাচে অবশ্য বলের চাইতে ব্যাট হাতেই বেশি উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি, ১৬৬ বল মোকাবেলা করে অপরাজিত ছিলেন ১০১ রানে। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই পেসার।

তাঁর মাঝে সম্ভাবনা ছিল ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা পেসার হওয়ার। কিন্তু ভাগ্যের মারপ্যাঁচ আর অসময়ে আবির্ভাবে অংকুরেই হারিয়ে গিয়েছেন ব্যাটসম্যানদের বুকে কাঁপুনি তোলা এই পেসার। কে জানে  গতিময় পেসারদের সুসময়ের আজকের দিনে আবির্ভাব হলে হয়তো ক্যারিয়ারের গতি পথটা অন্যরকম হত জনসনের। 

ক্রিকেটীয় জীবনের লড়াইটা বেশিদিন টানতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনও তাই। প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। মাত্র তিন দিন আগেই হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলেন। কিন্তু, কারও বোঝা হতে চাননি। তাই, মাত্র ৫২ বছর বয়সেই ব্যাঙ্গালুুরুতে নিজের ব্যালকনি থেকে ঝাপ দিয়ে স্বেচ্ছায় চলে যান জীবন নদীর ওপারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link