ভয়ংকর সুন্দর

নিজের দিনে ব্যাটসম্যানদের কাছে হয়ে উঠতেন রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’, ঠিক যেন ‘সাক্ষাৎ যম’! ছন্দে থাকা অবস্থায় ম্যালকমের মত গতিদানবকে মোকাবেলা করাটা বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানের পক্ষেও বেশ মুশকিলের হয়ে যেত। তবে ক্যারিয়ার জুড়ে ম্যালকম ছিলেন বেশ ইনকন্সিস্ট্যান্ট। শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ কিংবা লাইন-লেন্থের কোন বালাই থাকত না প্রায়ই।

১৯৯৪ সালে বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইংল্যান্ড সফরের একটি ঘটনা। ওভাল টেস্টে ইংলিশদের ব্যাটিংয়ের সময় ডানহাতি পেসার ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্সের একটি বাউন্সার সোজা গিয়ে লাগে ডেভন ম্যালকমের মাথায়।

ব্যস আর যায় কোথায়!

এক আঘাতেই সাবেক এই ডানহাতি পেসারের মেজাজটা গেল চড়ে! রাগে গজগজ করতে করতে প্রতিপক্ষের স্লিপ কর্ডনকে উদ্দেশ্য করে ছুঁড়ে দিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত ডায়লগ, ‘ইউ গাইজ আর হিস্ট্রি।

এর পরের অংশটা কেবলই ইতিহাস। গতিময় ফাস্ট বোলিংয়ের এক ‘ভয়ংকর সুন্দর’ প্রদর্শনী দু’চোখ ভরে অবলোকন করল পুরো ক্রিকেট বিশ্ব; মাত্র ৫৭ রানে ৯ উইকেটের ‘বিস্ফোরক’ এক স্পেলে প্রোটিয়া ব্যাটিং লাইনআপ গুড়িয়ে দিলেন ‘দানবীয়’ ফাস্ট বোলার ডেভন ম্যালকম!

একজন জেনুইন ফাস্ট বোলার তার উন্মত্ত গতি, প্রাণঘাতী বাউন্সার দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছেন! ক্রিকেট মাঠে এর চাইতে নির্মম, বিভীষিকাময় কিন্তু আনন্দদায়ক দৃশ্য আর কী হতে পারে? জর্জ লোহম্যান (৯/২৮) ও স্যার রিচার্ড হ্যাডলির (৯/৫২) পর টেস্টে যেকোন ফাস্ট বোলারের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড এটাই।

১৯৮৯ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ইংলিশদের হয়ে ৪০টা টেস্ট ও ১৬টা ওয়ানডেতে অংশ নিয়েছেন ম্যালকম। তাঁর প্রধান সম্পদ ছিল গতির সাথে লেট সুইং। ব্যাটসম্যানের শরীর তাক করে নিখুঁত বাউন্সারও দিতে পারতেন তিনি। এছাড়া তাঁর ছিল গুড লেংথ থেকে বলকে আচমকা ‘লিফট’ করানোর ক্ষমতা। নব্বই দশকের হাতে গোনা ক’জন জেনুইন ফাস্ট বোলারের একজন ছিলেন তিনি।

ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের ভাষ্যমতে, ‘ডেভন ম্যালকমের পুরোটাই ছিল একধরণের র পেস, বলটা অনেক গতি দিয়ে কখনো কখনো বাইরের দিকে সুইং করাতেন।’

জ্যামাইকার কিংস্টনে জন্মগ্রহণ করলেও ইংল্যান্ডে খেলার সুবাদে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে ডার্বিশায়ারের হয়ে খেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ। কাউন্টি লিগের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আর এক্স ফ্যাক্টর ‘র পেস’ দিয়ে দ্রুতই নির্বাচকদের নজর কাড়তে সমর্থ হন তিনি।

১৯৮৯ সালের অ্যাশেজ সিরিজ চলাকালীন ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অনেক সদস্য ‘নিষিদ্ধ’ দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সফরে খেলতে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করে। এর শাস্তিস্বরূপ সিরিজের শেষ দুই ম্যাচ থেকে তাঁদেরকে বাদ দেয়া হয়। ফলে ইংল্যান্ডের হয়ে ম্যালকমের টেস্ট অভিষেকের পথটা আরও মসৃণ হয়ে যায়।

ইতোমধ্যেই ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের শেষ টেস্টের মূল একাদশে সুযোগ পেয়ে যান ২৬ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার ডেভন ম্যালকম। অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী জুটি মার্ক টেলর-জিওফ মার্শ অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় সারাদিন কাটিয়ে দিলে তাঁর অভিষেক টেস্টের প্রথম দিনটা পার করতে হয় উইকেটবিহীন অবস্থায়।

অবশেষে ম্যাচের দ্বিতীয় দিন স্টিভ ওয়াহকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠান শূন্য রানে। অভিষেক ম্যাচে ম্যালকমের ভাগ্যে ওই একটা উইকেটই জুটেছিল। ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল এক ইনিংস ও ১৮০ রানের ব্যবধানে।

১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচটা হয়েছিল ম্যালকমের জন্মভূমি কিংস্টনে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭০ রানে ৪ উইকেট নিয়ে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ডেভন ম্যালকম।

পোর্ট অব স্পেনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ১০ উইকেট তুলে নেন ম্যালকম। দুই ইনিংসে তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ছিল যথাক্রমে ৪/৬০ ও ৬/৭৭।

চার টেস্টে ১৯ উইকেট নিয়ে সেবারের ক্যারিবিয়ান সফরে ইংল্যান্ডের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়েছিলেন ডেভন ম্যালকম।

টেস্টে ডেভন ম্যালকমের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্সের মধ্যে আছে ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ৫/৯৪, এজবাস্টনে ৫/৪৬; ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে কেনিংটন ওভালে ৫/৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাডিলেড ওভালে ৪/৩৯।

১৯৯৪ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ৫৭ রানে ৯ উইকেটের সেই ‘প্রলয়ঙ্করী’ স্পেলটি জর্জ লোহম্যানের পর টেস্টে এখনও পর্যন্ত কোন ইংলিশ ফাস্ট বোলারের সেরা বোলিং ফিগার। মূলত ওই পারফরম্যান্সটির কারণেই ১৯৯৫ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের মর্যাদায় ভূষিত হন তিনি।

১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পর ইংল্যান্ড দলের ম্যানেজার রে ইলিংওয়ার্থের সাথে ডেভন ম্যালকমের সম্পর্কের চরম অবনতি হতে থাকে। এছাড়াও ইংল্যান্ডের তৎকালীন বোলিং কোচ পিটার লিভারের সাথেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়।

প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সিরিজের শেষ টেস্টে দ্বিতীয় নতুন বল হাতে খুব বাজে বল করেছিলেন ম্যালকম। যার ফলশ্রুতিতে ডেভ রিচার্ডসন ও পল অ্যাডামসের শেষ উইকেট জুটিতে উঠেছিল ৭৩ রান। এর মাশুল ইংল্যান্ডকে গুনতে হয়েছিল ১০ উইকেটের পরাজয় বরণের মাধ্যমে।

ডেভন ম্যালকমের ৮ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৯৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজের শেষ টেস্টে। প্রথম ইনিংসে ১১ ওভার বোলিং করে ছিলেন উইকেটশূন্য। তবে দ্বিতীয় ইনিংসের তৃতীয় বলেই ম্যাথু এলিয়টকে (৪) লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন তিনি। অভিষেক টেস্টের মত বিদায়ী টেস্টেও ম্যালকমের কপালে মাত্র একটা উইকেটই জুটেছিল!

ইংল্যান্ডের পক্ষে ৪০ টেস্টে তিনি উইকেট পেয়েছেন ১২৮টি আর ওয়ানডেতে ১০ ম্যাচে ১৬টি। নিজের দিনে ব্যাটসম্যানদের কাছে হয়ে উঠতেন রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’, ঠিক যেন ‘সাক্ষাৎ যম’! ছন্দে থাকা অবস্থায় ম্যালকমের মত গতিদানবকে মোকাবেলা করাটা বিশ্বের বড় বড় ব্যাটসম্যানের পক্ষেও বেশ মুশকিলের হয়ে যেত। তবে ক্যারিয়ার জুড়ে ম্যালকম ছিলেন বেশ ইনকন্সিস্ট্যান্ট। শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ কিংবা লাইন-লেন্থের কোন বালাই থাকত না প্রায়ই।

জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের সাবেক এই গতিদানব; ইংলিশ ক্রিকেটিং ফোকলোরে যিনি পেয়েছেন ‘কাল্ট হিরো’র মর্যাদা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...