ধোনি ও চেন্নাই: আইপিএলের হিরোইজম

২০০৮ সাল। চেন্নাই ট্রেড সেন্টার। চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সি উন্মোচন অনুষ্ঠান। সিনেমার লোক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম – রীতিমত লোকে লোকারণ্য। সন্ধ্যা গড়িয়ে সেই অনুষ্ঠান রাতে পৌঁছালো। তাইওয়ানের এক জুটি অ্যাক্রোব্যাটিক শো দেখালেন, লেজার শো দেখালেন এখন রাশিয়ান।

দর্শক সারির সামনের দিকের সোফায় সাধারণ এক সাদা টি-শার্ট আর ধুসর জিন্স পরে বসে আছেন একজন মুগ্ধ হয়ে সব দেখছেন। তারুণ্য যার চোখ দিয়ে জ্বল জ্বল করে দেখা যাচ্ছে সেই মহেন্দ্র সিং ধোনি আসলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন সেই হলুদ জার্সিটার।

অপেক্ষার লম্বা প্রহর শেষ হল। সাদা টি-শার্টের ওপর জার্সি গায়ে চাপালেন ধোনি, তখনও কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, হয়তো হলুদের সেই মোহ হিরোইজমের রুপ নিয়ে চেন্নাইয়ের বুকে টিকে রইবে অনন্তকাল। কে যেন মাইক হাতে নিয়ে তামিল দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলতে বললেন। কে জানতো, এই ধোনিই একদিন চেন্নাই শহরের ‘থালাইভা’ বনে যাবেন। কেউ কেউ হয়তো তাঁকে স্বয়ং সুপারস্টার রজনীকান্তের চেয়েও ওপরে স্থান দেবে।

ওপরে ওঠার সেই বীজটা ওইদিনই বুনে ফেলেছিলেন ধোনি। ২৬ বছর বয়সী ধোনি তারুণ্যভরা কণ্ঠে, মুখে এক বড় হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদেরকে শিরোপা জেতাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব।’ কি দৃঢ়তা! কি আত্মবিশ্বাস! মহেন্দ্র সিং কথা রেখেছিলেন তিনি চেন্নাই সুপার কিংসকে জিতিয়েছিলেন চারবার ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) শিরোপা। চেন্নাইয়ের বাইরের ছেলে হয়ে গেল একেবারে ঘরের ছেলে।

আইপিএল শুরুর বছরে নিলামে প্রতি দলে একজন করে আইকনিক খেলোয়াড় নেওয়ার সুযোগ ছিল। অর্থাৎ প্রতিটি ফ্রাঞ্চাইজি তাঁদের দলে একজন কর সেই প্রদেশের কোন তারকা খেলোয়াড়কে দলে ভেড়াতে পারত। এক্ষেত্রে মাথায় ছিল ভক্তদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো। দলের সাথে সেই প্রদেশের সমর্থকদের একটা ইমোশনাল বন্ধন সৃষ্টি করাই ছিল লক্ষ্য। তবে এখান থেকে খানিক ভিন্ন ছিল চেন্নাই।

আইকনিক খেলোয়াড় নেওয়ার পেছনে আরও একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটা আইকনিক খেলোয়াড়কে নিলাম থেকে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকে কেনা খেলোয়াড়ের থেকে দশ শতাংশ বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

ঠিক এই জায়গাতেই নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল চেন্নাই সুপার কিংস ফ্রাঞ্চাইজি। তাঁরা কোন আইকনিক খেলোয়াড় কেনার পরিবর্তে নিলাম থেকেই সব খেলোয়াড়কে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যার ফলে তাঁরা কোন রকম দ্বিধা-দ্বন্দ ছাড়াই ধোনির জন্যে অর্থ খরচ করতে পেরেছিল।

মহেন্দ্র সিং ধোনি ২০০৮ সালে ছিলেন ২৬ বছর তরুণ একজন ক্রিকেটার। যে কিনা সদ্যই ভারত জাতীয় দলকে জিতিয়েছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই এমন সাফল্য ধোনি প্রথম আইপিএলের নিলামের ‘হট কেক’-এ পরিণত করেছিল। সবার প্রত্যাশাই ছিল তাঁকে দলের নেওয়ার। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স বেশ একটা লড়াইও করেছিল।

পাঁচ মিলিয়ন ডলারের পার্সের ১.৫০ মিলিয়ন অবধি উঠেছিল ধোনির মূল্য। কিন্তু মুম্বাইয়ের মাথায় তখন চিন্তা আসে শচীনকে ধোনির থেকেও ১০ শতাংশ অধিক অর্থ দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে মুম্বাইয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় হয়ে যেত মুম্বাইয়ের। তাতে লোকসানের পাল্লা হত ভারি। আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে চেন্নাই কিনে নেয় ধোনিকে। আর এরপরের গৌরবগাঁথা তো সবার জানাই।

তবে তাঁর থেকেও বড় বিষয় ধোনি চেন্নাইয়ের ছেলে না হয়েও এখন ঘরের সবচেয়ে আদরের ছেলে। এর পেছনে ধোনির ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রই প্রধান কারণ। ধোনি একেবারে নিজের ঘর মনে করেই চেন্নাইকে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাছাড়া ধোনি তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে গিয়েছেন চেন্নাইয়ের মানুষদের ভাল কিছু উপহার দিতে। হোক সেটা শিরোপা কিংবা কিছু মনে রাখার মত মুহূর্ত। সেই সাথে অঢেল বিনোদন।

ধোনির তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে ২০১১ সালেও ভারতকে জেতালেন তাঁদের দ্বিতীয় ওয়ানডে বিশ্বকাপ। তারপর থেকেই যেন পুরো ভারতবর্ষে ধোনির থেকে জনপ্রিয় কেউ যেন নেই। চেন্নাইয়ের মানুষ একেবারে দু’হাত মেলে টেনে নিলেন ধোনিকে। আইকনিক খেলোয়াড় না হয়েও ধোনি বনে গেলেন আইপিএলের সবচেয়ে আইকনিক খেলোয়াড়। তাঁর চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণে।

এই জায়গায় আবার ধোনি নিজের প্রতি ভালবাসা বাড়িয়ে নিলেন। চেন্নাইয়ের মানুষদের মনের মণিকোঠায় বিশাল এক জায়গা দখল করে নিলেন। ছেড়ে যাননি চেন্নাইকে। হয়ত অর্থের তূলনায় হেরফের হত। তবুও তিনি রয়ে গেলেন। হয়ে রইলেন ‘থালাইভা’।

ধোনির এমন কাণ্ডে আইপিএলে সেই প্রদেশের খেলোয়াড় প্রীতি বা তাঁদেরকে দলে রেখে খেলোয়াড়দের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পন্থা বদলে দেয় সম্পূর্ণ। যেখানে প্রথম আসরে প্রদেশ কিংবা শহরকে প্রতিনিধিত্ব করা খেলোয়াড়দের সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধশতকের কাছাকাছি।

কিন্তু, সে সংখ্যাটা ক্রমশ কমেছে। এখন ঘরের ছেলে হতে হলে আর সত্যিকার অর্থেই ঘর থেকেই হতে হয় না। এই যেমন ধরুণ বিরাট কোহলি। দিল্লির ছেলে অথচ ব্যাঙ্গালুরুর সাথে যেন তাঁর জন্মান্তরের এক সম্পর্ক হয়ে গেছে। সেই ধোনির ক্যারিশমা অবশ্য ছড়িয়ে আছে সমগ্র ভারত জুড়েই।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছেন ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক ধোনি। তবু আজও ভারতের যেকোন প্রান্তে শচীন টেন্ডুলকারের মতোই ধোনি পূজনীয়। আজও ভারতের যেকোন স্টেডিয়াম যেন হয়ে যায় ২০১১ এর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। ধোনি, ধোনি চিৎকারের গগন ফাঁটে। ক্যারিশমেটিক ধোনির, ক্যারিশমার আরও একবার দেখা মিলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link