মাঝে মাঝে ভাবি, ক্রিকেটের ইতিহাসে একমাত্র ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনটি আলাদা সীমিত ওভারের আইসিসি ট্রফি থাকা সত্বেও, মহেন্দ্র সিং ধোনি তাঁর নিজের দেশেই কতটা নিন্দিত, সমালোচিত হন। এই ঘটনা সম্ভবত ক্রিকেটবিশ্বে বিরল। অস্ট্রেলিয়ার মত ব্যক্তিপুজা সংস্কৃতিকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া দেশেও বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ককে কোনোদিন এভাবে সমালোচিত হতে হয়েছে বলে জানা নেই। বর্ডার, স্টিভ অধিনায়ক হিসেবে বন্দিত একটি করে বিশ্বকাপ পেয়েই। টেলর, একটিও না পেয়েও প্রশংসিত টিম তৈরির জন্যে। পন্টিংকে ছেড়েই দিচ্ছি। সেখানে ধোনির ক্যাবিনেটে তিন তিনটি আইসিসি ট্রফি! আর হ্যাঁ, কালকের পরে পাঁচ পাঁচটি আইপিএল ট্রফি।
২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেই যদি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিতেন, তাহলেও ট্রফির বিচারে তিনি ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হিসেবেই রিটায়ার করতেন। কিন্তু ধোনি খেলেছেন, আরো দশ বছর। এবং দেখেছেন – নিজেকে হিরো থেকে ধীরে ধীরে ভিলেন হয়ে যেতে। ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমায় একটি বিখ্যাত সংলাপ ছিল – ‘Either you die a hero, or live long enough to see yourself become the villain. ধোনি কি নিজের সঙ্গে ব্যাটম্যান কে রিলেট করতে পারেন?’
মাঝে মাঝে ভাবি। যে ধোনির আর দোষ কি? যে দেশে শচীনকে শুনতে হয়েছে স্বার্থপর, রেকর্ডের জন্যে খেলেন, টিমম্যান নন, মিথ্যেবাদী। হ্যাঁ, সেখানে ধোনিকে নিয়ে সমালোচনা হবে তাতে সন্দেহ কি? যেখানে দুজনেই নিজের প্রাইম ফর্ম পেরিয়ে যাবার পরেও খেলে গেছেন। কালকে পঞ্চম আইপিএল ট্রফি জেতার পরেও ধোনির কাছ থেকে সরাসরি কোনো ঘোষণা নিজের অবসর নিয়ে আসেনি।
শচীনের সাথে ধোনির পার্থক্য অনেক। শচীন পারতপক্ষে মুখ খুলতেন না। ধোনি সেখানে সোজাসাপ্টা। কেনো পরমাণু বোমা? নয় কেন অন্ন? – বলার মত বিশ্বকাপ জিতে উঠে রবি শাস্ত্রীকে বলতে পারেন – রবি, আজকে না জিতলে তোমরা আমাকে প্রশ্ন করতে, কেনো যোগিন্দর সিং? কেনো নয় হরভজন? (২০০৭) বা কেনো শ্রীশান্ত, কেন নয় অশ্বিন? (২০১১)। ক্যাপ্টেন কুল নামে ডাকা হয় তাকে, শুধুমাত্র উইকেটের পিছনে থেকে বরফশীতল মস্তিষ্কের জন্যে নয়।
চূড়ান্ত উত্তেজক ফাইনাল জিতে বা হেরেও যাঁর মুখের একটা পেশিও কাঁপে না। ট্রফি জিতে কোনো জুনিয়রের হাতে তুলে দিয়ে যিনি চলে যান ফ্রেমের একদম কোণে।
সেই ধোনি, তর্কযোগ্যভাবে নিজের শেষ আইপিএল খেলতে নেমেছিলেন এবার। সারা বছর আর কোনো টুর্নামেন্টে দেখা যায়না ধোনিকে। তিনি নিজেও জানেন, বয়স থাবা বসাতে শুরু করেছে তাঁর সেই চিতার মত ক্ষিপ্র রানিং বিটুইন দা উইকেটস বা শেষ ওভারে খেলা নিয়ে গিয়ে বিগ হিট নিয়ে ফিনিশ করার স্কিলে।
তাই অবিশ্বাস্যভাবে সব ইগো ছেড়ে নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে নামিয়ে নিয়েছিলেন আট নম্বরে। জানতেন, দলে অন্তত আরো সাতজন ফর্মে থাকা যুবক ব্যাটার আছেন যাঁরা টি টোয়েন্টি ব্যাটিং আজকে দাঁড়িয়ে তাঁর থেকে ভালো করেন। দলের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত বিফলে যায়নি। চেন্নাই সর্বপ্রথম দল হিসেবে ফাইনালে উঠেছিল।
ফাইনালে ঋতুরাজ, কনওয়, রায়াডু আর রাহানের বিক্রমে টার্গেট যখন ১৪ বলে ২২, তখন দর্শকাসনে বিপুল উল্লাস সৃষ্টি করে নিজেকে প্রমোট করে ছয় নম্বরে নামলেন তিনি। ভেবেছিলেন, এই বয়সেও, এই রানটা তিনি করে দিতে পারবেন।
কিন্তু ভাগ্যবিধাতা আড়ালে মুচকি হেসেছিলেন। মোহিত শর্মার অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল কভারের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিতে গিয়ে মিলারের হাতেই ধরা পড়লেন। জীবনের শেষ আইপিএল ফাইনালে গোল্ডেন ডাক! নিমেষে স্তব্ধ চেন্নাই সমর্থকদের জনসমুদ্র যাদের জন্যে এতক্ষণ বোঝা যায়নি খেলাটা মোতেরায় হচ্ছে না চিপকে।
ড্রেসিংরুমে ফিরে যেতে যেতে ধোনির কি মনে হয়েছিল, যে আর না, যে জিনিস আমার কাছে ব্রেড অ্যান্ড বাটার ছিল, আজকে সেই কাজটাই আমি করতে পারছি না। সরে যাবার এই সময়। কিন্তু বিজয়ী হিসেবে, না বিজিত? এই বিশ্ব বিজয়ীকে মনে রাখে। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।
ডাগ আউটে বসে ধোনির হতাশাগ্রস্ত মুখ দেখে কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল তাঁর মনে কি চলছে।
শেষ দু’বলে দশ বাকি থাকা অবস্থায় গুজরাটের সেলিব্রেশন মুড ভেঙ্গে দিয়ে স্যার জাদেজার ছক্কা ও চার, এবং উল্লাসে দৌড়ে গিয়ে ধোনির কোলে উঠে পড়ার পর ক্যামেরা যখন ধোনির মুখে ফোকাস করলো! তখন হতবাক হয়ে গেলাম! এ কি দেখছি!
ক্যাপ্টেন কুল, তিনটি আইসিসি ট্রফি জিতে যিনি ক্যামেরাকে উপহার দিয়েছেন একটু মুচকি হাসি, চারটি আইপিএল জিতে যিনি ট্রফি নিয়েই দলের কনিষ্ঠতম সদস্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরে গেছেন, যেনো এসব ট্রফি জেতা তাঁর বাঁহাতের খেল! ধোনি কাঁদছেন! জাদেজাকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ধোনি কাঁদছেন! একচল্লিশ বছর বয়সে, যখন ক্রিকেট থেকে তাঁর আর নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই, তখন অবশেষে পাথর ফেটে জল বেরোলো!
নাকি পাওয়ার ছিল? প্রমাণ করার ছিল শেষবারের মত একবার, যে তিনি বুড়ো হতে পারেন, তাঁর ব্যাটিং আগের মত না থাকতে পারে, কিন্তু উইকেটের পিছনে তাঁর বাজপাখির মত ক্ষিপ্র গ্লাভস আর ক্ষুরধার বরফশীতল মস্তিষ্কের রিপ্লেসমেন্ট এখনও ভারতীয় ক্রিকেট পায়নি? শেষবারের মতো একবার বলার ছিল, যতো নিন্দা করেছো আমার, ভেবে দেখো, ততটাও নিন্দার যোগ্য আমি ছিলাম কি?
কে বলতে পারে? কেননা মহেন্দ্র সিং ধোনি তো একজন প্রহেলিকা। যাঁর মনের নাগাল আজ অবধি কেউ পেলোনা।
আমি চেন্নাই এর সমর্থক নই, কিন্তু কালকের খণ্ড খণ্ড কিছু দৃশ্য আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে, চেন্নাই সুপার কিংস, শুধু একটা দল নয়, একটা ইমোশন।