Social Media

Light
Dark

একটি ভাঙা-নাক ও জমে থাকা প্রতিশোধের গল্প!

১৯৯৪ সাল, বিশ্বকাপ বসেছে আমেরিকায়।

নস্টালজিয়ায় মেতে থাকা লোকেদের জন্য সে বিশ্বকাপ স্মৃতির আখড়া। ব্যাজিওর পেনাল্টি মিস, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধার, ম্যারাডোনার ডোপ পাপে বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ হওয়া। কিন্তু স্প্যানিশদের কাছে সে সব গল্পই তুচ্ছ। তাদের মনের কোনায় সে বিশ্বকাপ হয়ে আছে এক অবিচারের গল্প, স্মৃতি হয়ে আছে নিজেদের রক্তাক্ত ইতিহাস।

স্পেন-ইতালির ইতিহাসটা বহু পুরোনো, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, দুই দিক দিয়েই তারা একে অপরের বন্ধু। বিশাল একটা সময় ফ্যাসিজমের অধীনে কাটানো দুই দেশ পুরোনো বন্ধুত্ব ভোলেনি। কিন্তু ফুটবল মাঠেই তাদের গল্পটা সম্পূর্ণ আলাদা। ফুটবল এলেই দুই দলের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দূরত্ব, পরিণত হয় একে অপরের শত্রুতে।

কত গল্প-ইতিহাস লেখা এই দুই দলের মাঝে!  আছে এই দুই দলের সাথে। সেই গল্পে হাসি-কান্না, আনন্দ-লজ্জা সবকিছুর গল্পই লেখা আছে নিজের মতন করে। কিন্তু সেইসব গল্পের স্প্যানিশদের স্মৃতিতে সবচেয়ে বেশি ভেসে ওঠা গল্পটা এক রক্তাক্ত গল্প। যার সাথে জড়িয়ে আছে সাবেক স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকের নামও। ২৪ বছর বয়সী টগবগে যুবকের রক্তাক্ত আর প্রতিশোধ নিতে না পারার এক ইতিহাস!

৯ জুলাই, ১৯৯৪। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাসাচুসেৎসের ফক্সব্রো স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ইতালি ও স্পেন। আরিগো সাচ্চির ইতালি তখন স্মরণকালের সেরা ডিফেন্ডারদের আখড়া। বারেসি চোটের কারণে ছিলেন মাঠে বাইরে। তার বদলে দলে প্রবেশ করেছিলেন মাউরো টাসোট্টি।

আর তাদের মুখোমুখি তরুণ এক স্পেন; এনরিকে, হিয়েরো, হোসে লুইস কামিনেরোর মতন খেলোয়াড়েরা। পার্থক্যটা স্পষ্ট, কিন্তু স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের ক্লেমেন্তে হাল ছাড়েননি। তিনি জানতেন, এই ইতালিকেও থামিয়ে দেওয়া সম্ভব, শুধু একটু বুদ্ধি খাটিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের ধরে রখতে পারলেই।

২৫ মিনিটেই দিনো ব্যাজিওর গোলে এগিয়ে যায় ইতালি। স্পেনকে ৫৮ মিনিটে সমতায় ফেরান অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের লুইস ক্যামিনেরো। ম্যাচের একদল শেষ সময়ে ইতালির ত্রাণকর্তা হয়ে আসেন রবার্তো ব্যাজ্জিও, গোলরক্ষক জুবিজারেতাকে কাটিয়ে নিজের স্বভাবসুলভ স্টাইলে ইতালিকে এগিয়ে নেন ‘দ্যা ডিভাইন পনিটেইল’।

৮৮ মিনিটের গোলে সকলে ম্যাচের শেষই ভেবেছিল, কিন্তু তরুণ স্প্যানিশ দলের তখনও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি। ম্যাচের বাকি থাকা দুই মিনিটই হয়ে উঠল স্প্যানিশ ইতিহাসের এক রক্তাক্ত ইতিহাস!

ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ, চলছে যোগ করা সময়ের খেলা। এই আক্রমণই হতে পারে এই ম্যাচের শেষ আক্রমণ। এমন সময় মাঠের বামপ্রান্ত থেকে ক্রস ছুঁড়লেন হোসে আন্দোনি গোয়কোয়েকচিয়া। ক্রসটা তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ছিল না, বরং ইতালি ডিফেন্স চাইলেই সহজে তা বের করে দিতে পারতো মাঠের বাইরে। ম্যাচের শেষ মিনিটে প্রাণপণ ছুটে যাচ্ছিলেন এনরিকে, একটি গোলের জন্য।

কিন্তু এমন সময়েই ডি-বক্সের ভেতরে রাইটব্যাক মাউরো টাসোট্টি কনুই মেরে বসলেন এনরিকেকে। বল পৌঁছালো না কারো কাছেই, আস্তে আস্তে চলে গেল মাঠের বাইরে। ওদিকে নাক চেয়ে শুয়ে পরলেন তৎকালীন রিয়াল মিডফিল্ডার। টাসোট্টি ভাবসাব এরকম, যেন কিছুই জানেন না তিনি। পুরো স্পেনবাসী যখন পেনাল্টি আবেদনে গলা ফাটাচ্ছে, রেফারি তখন নির্দেশ দিলেন থ্রো-ইনের, তাও আবার ইতালির পক্ষে।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়েছিল পুরো স্পেন, লুইস এনরিকে তখন রক্ত হাতে নাক চেপে চিৎকার করে যাচ্ছেন রেফারির সাথে। দেখেও যেন না দেখার ভাব করে আছেন হাঙ্গেরিয়ান রেফারি সান্দর পুল। প্রতিটি খেলোয়াড়ের চিৎকার, চেঁচামেচি কোনোটাই কাজে দিল না। ফিজিও এসে বারবার এনরিকের রক্ত মুছে দিচ্ছেন, নাক-মুখ থেকে তখনও অনর্গল রক্ত পড়ছে তার।

সেই ভাঙা নাক নিয়েই তেড়ে যান টাসোট্টির দিকে, যেন জানতে, কেন? দূরে রখন টাসোট্টি দাঁড়িয়ে আছেন তার নিষ্পাপ অভিব্যক্তি নিয়ে। লড়াই করতে থাকা এনরিকে মাঠ ছাড়তে তখনও নারাজ, ফিজিও-খেলোয়াড়েরা জোর করে মাঠের বাইরে নিয়ে আসেন তাকে। ১০ জনের স্পেন লড়াই করে আরো কতেক মিনিট। এরপর রেফারি পুল বাজান তার শেষ বাঁশি। ২-১ গোলে জয়ের আনন্দ নিয়ে সেমিতে পা রাখে ইতালি। ভাঙ্গা নাক আর স্বপ্নভঙ্গের স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফেরেন এনরিকে।

ঘটনা ওখানেই শেষ নয়, এই ম্যাচের পরই আলোচনায় বসে উয়েফা। রেফারিং কমিটি থেকে ৮ ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হয় মিলান রাইটব্যাককে। জরিমানা করা হয় রেফারিকেও। মাঠের মধ্যে কোনো শাস্তি না পেলেও মাঠের বাইরে তাকে সে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হয়। তার ইতালি ক্যারিয়ারের ইতিও টানা হয় সেদিন। কিন্তু মাঠের ভেতরে সেদিন আর ন্যায় বিচার পাওয়া হয়নি এনরিকের।

সেই ইতালি ফাইনালে গিয়ে হারে ব্রাজিলের কাছে, স্প্যানিশদের এখনও বিশ্বাস, ‘এই হার তাদের কুকর্মের ফলাফল’। নইলে ব্যাজ্জিও মত তারকা চাপ সামলাতে না পেতে পেনাল্টি মিস করেন? স্পেন অবশ্য দিনে দিনে তাদের প্রতিশোধ চুকিয়ে নিয়েছেন।

অনেকদিন পেড়িয়ে গেছে।  স্পেন তার প্রতিশোধ তুলে নিয়েছে ইতালিকে হারিয়ে দুইবার ইউরো উঁচিয়ে। ২০০৮ ইউরোর কোয়ার্টারে, ২০১২ ইউরোর ফাইনালে; শিরোপা উঁচিয়ে লুইস এনরিকের সাথে হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন ইকার ক্যাসিয়াস, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তারা। তবুও পুরোনো স্মৃতি, ভেঙে যাওয়া নাকের গল্প কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link