‘কখনোই ভাবিনি যে সেঞ্চুরি হবে’

অবিস্মরণীয় এক সময় পার করছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। একটা অভাবনীয় সময়। তিনি হয়ত অনূর্ধ্ব-১৯ এর দিনগুলো থেকেই ঠিক এমন সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভারতের বিপক্ষে কি দুর্দান্ত তাঁর ব্যাট! কি অসাধারণ তাঁর সক্ষমতা, দক্ষতা! স্নায়ুচাপ সংবরণ করবার এত দৃঢ়তা তিনি অর্জন করেছেন সময়ের সাথে। তিনি হয়েছেন পরিণত। সে সবকিছুর প্রভাবটাই দেখা গেল মাঠের ক্রিকেটে।

প্রথম ম্যাচে ৩৮ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংসে দলকে ম্যাচ জেতালেন। এরপর তো তাঁর ব্যাটার সত্ত্বাটা আরও খানিকটা বিকশিত হয়েই সামনে এলো। পেয়ে গেলেন নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম শতক। এই সেঞ্চুরিটা আরও আগেই হয়ত আসতে পারত। যদি তিনি ঠিকঠাক সুযোগটুকু পেতেন। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তো তিনি অলরাউন্ডার রোলেই দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি তো ছোট থেকেই একজন অলরাউন্ডার। তবে জাতীয় দলে কেবল একজন বোলার হিসেবেই তিনি হতেন বিবেচিত।

কিন্তু যখন সুযোগ পেলেন, তখনই সুযোগ দু’হাতে লুফে নিলেন। তাইতো দারুণ উচ্ছ্বসিত মিরাজ। দলকে ম্যাচ জয়ে অবদান রাখতে পেরেছেন। তাইতো উচ্ছ্বসিত মিরাজের কণ্ঠে স্বস্তির সুর। তিনি বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। ম্যাচ জিততে পেরেছি, এজন্য আরও ভালো লাগছে। আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, ছয় উইকেট পড়ে গিয়েছিল। রিয়াদ ভাই ও আমার জুটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খুব ভালো লাগছে।’

মিরাজ সবসময়ই দলের জন্যে চিন্তা করে গেছেন। তিনি বরাবরই একজন ‘টিম ম্যান’। নিজের এমন দুর্দান্ত ইনিংসের পরও তিনি দলগত সাফল্যেই সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কেননা মিরাজ যখন ব্যাট করতে নামেন তখন তো দল একেবারে খাদের কিনারায়। খালি মিরাজ কিংবা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের পা হড়কে যাবার অপেক্ষা। তবে না সেখান থেকে রিয়াদ ও মিরাজের দৃঢ়তায় ঘুরে দাঁড়ায় টাইগাররা। দুই জনে মিলে গড়ে ফেলেন ১৪৮ রানের জুটি।

যেটা অষ্টম উইকেটে ভারতের বিপক্ষে যেকোন দলের সর্বোচ্চ রানের জুটি। আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ভারতের বিপক্ষে যেকোন পজিশনেই সেই পার্টনারশীপটা সর্বোচ্চ। এমন একটা জুটি নিয়ে আলাপ হওয়াটাও তো বেশ স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। মিরাজও তাই অনর্গল সেই পার্টনারশীপ নিয়ে বলেছেন ম্যাচ পরবর্তী সময়ে।

তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে কত রান করতে হবে এমন কোন চিন্তা করিনি। ছয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আর কত রানই বা করবেন! আমার আর রিয়াদ ভাইয়ের মাঝে কথা হচ্ছিল, বল টু বল খেলা, ছোট ছোট পার্টনারশীপ করা। আমরা পরিস্থিতি বুঝে ব্যাটিং করার চেষ্টা করেছি। আমাদের দু’জনের জুটি খুবই ভালো হয়েছে।’

এই পরিস্থিতি বিচার করতে করতে, মিরাজের হাত ধরে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় একটা বড় সংগ্রহের দিকে। সেখানে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও কম অবদান রাখেননি। তাছাড়া মিরাজের মানসিক দৃঢ়তা রিয়াদকেও বিমোহিত করেছিল। তাইতো অভিজ্ঞতার বিচারে পিছিয়ে থাকা মিরাজের কথারও প্রাধান্য দিয়েছিলেন রিয়াদ। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের নায়ক মেহেদি হাসান মিরাজ।

মিরাজ বলেন, ‘একটা ব্যাপার ভালো লেগেছে, রিয়াদ ভাই সিনিয়র হয়েও আমাকে শ্রদ্ধা করেছেন, আমার কথা শুনেছেন। এটা আমার কাছে ভালো লেগেছে। রিয়াদ ভাই মাঝেমধ্যে যখন একটু চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিলেন যে আক্রমণ করি, তখন আমি তাকে বোঝাচ্ছিলাম এই পরিস্থিতিতে আক্রমণ না করে আমরা যদি আরেকটু দেখেশুনে খেলে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে ভালো হবে। এই আলোচনাগুলি কাজে লেগেছে।’

হ্যা, সে আলোচনাগুলো কাজে লেগেছে। তাইতো ৬৯ রানের ছয় উইকেট হারিয়েও বাংলাদেশ শেষ অবধি পৌঁছে যায় ২৭১ রান অবধি। তবে বাংলাদেশের পরিকল্পনা ছিল ২৫০ রানের আশেপাশে। সে নিয়ে মিরাজ বলেন, ‘আমার একটাই পরিকল্পনা ছিল, ৫০ ওভার ব্যাট করব। রিয়াদ ভাই যখন আউট হয়ে গেলেন, তখন ভেবেছি রানটা যদি ২৪০-২৫০ পর্যন্ত নিতে পারি, তাহলে ভালো হবে। ২৩০ রানের খেলা একরকম, ২৫০ হলে আরেক রকম।’

মিরপুরের পিচ ব্যাটিং সহায়ক নয়। তেমনটা সবাই বলে আসছে। তবে দ্বিতীয় ম্যাচের পিচটা ব্যাটারদের জন্যের বেশ সহয়াকই ছিল বলা চলে। দুই দলই তো রান করেছে। তবুও ওই যে অতিরিক্ত ২০ কি ২১ রানই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। সেদিক বিবেচনায় নাসুম খানিকটা প্রশংসা প্রাপ্য। কেননা রিয়াদের প্রস্থানের পর নাসুমের ক্যামিও ইনিংসটিই তো বাংলাদেশের সংগ্রহকে খানিকটা বাড়তি বুষ্ট দিয়েছে। মিরাজ তাই নাসুমের প্রশংসা করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।

তিনি বলেন, ‘নাসুম ভাই অসাধারণ ব্যাট করেছে। উনি যে ২০-২৫ রান করেছেন, দলের জন্য তা অনেক সহায়তা করেছে। বিশেষ করে রান যেখানে হতো ২৫০, সেখানে ২৭০ হয়েছে। এই কৃতিত্ব অবশ্যই নাসুম ভাইয়ের। তিনি ওখানে দ্রুত রান করেছেন। তাঁর এই ছোট অবদান দলের জন্য জরুরি ছিল।’

তবে মিরাজ হয়ত আদৌ বিশ্বাস করেননি যে তিনি সেঞ্চুরি পেয়ে যাবেন। কেননা ইনিংসের ৪৮ ওভার শেষে মিরাজের রান ছিল ৭২। এমন এক পরিস্থিতিতে হার্ডহিটার ব্যাটার ছাড়া সেঞ্চুরি আদায় করা খানিকটা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে মিরাজ সেটা করে দেখিয়েছেন। ইনিংসের একেবারে শেষ বলে তিনি নিজের সেঞ্চুরিটি তুলে নিয়েছেন। নিজের সে অবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে মিরাজ বলেন, ‘না, এটা কখনোই ভাবিনি যে সেঞ্চুরি হবে। তবে দলের জন্য খেলেছি, ফ্লো ছিল, আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল, হয়ে গেছে।’

মিরাজের জীবনে এটা অনেক বড় পাওয়া, এমনটা তিনিই বিশ্বাস করেন। কেননা দিনশেষে তিনি ভারতের মত শক্তিশালী একটা দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন। দল জিতেছে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে এই অর্জনগুলোই তো মিরাজদের আগামী দিনে ভাল করবার অনুপ্রেরণা দেয়। মিরাজ নিশ্চয়ই উজ্জীবিত। তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার মিশনে নিজেকে উজাড় করে দেবেন। সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে দলের জন্যে নিবেদিত প্রাণ এক ক্রিকেটার হয়ে রবেন। দল তাঁকে মূল্যায়ন করুক কিংবা না করুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link