ম্যাচ শেষে মাশরাফি বিন মুর্তজার ঠোঁটে সেই চিরচেনা জয়ের হাসি। এই মঞ্চটা তাঁর চেনা – পাঁচবার তিনি মোট এই মঞ্চে ট্রফি জিতেছে। এত হাসি, এত আনন্দ, এত উদযাপনের মাঝেও বললেন, ‘ম্যাচটা আমরা খেলেছি শহিদুলের জন্য, ম্যাচটা জিতেছি ওর জন্যই।’
মাশরাফির এই কণ্ঠটা খুব চেনা। এটা সেই কণ্ঠ যেটা বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুর পরদিন ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারতে বিপক্ষে মাঠে নামার আগে বলেছিলেন, ‘ধরে দেবানি!’
সেই মাশরাফিররা এবার ম্যাচটা খেলেছিলেন শহিদুলের জন্য। ট্রফিটা উৎসর্গ করেছেন, শহিদুলকে – শহিদুলের বাবাকে।
শেষ ম্যাচ খেলেননি শহিদুল। খেলবেন কি করে, জীবনটাই যে ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল। বাবা চলে গিয়েছিলেন জীবন নদীর ওপারে। খবর পেয়েই চলে গেলেন নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে – শেষ বারের জন্য বাবাকে দেখবেন বলে।
কোয়ালিফায়ারের আগে সাত ম্যাচে পান ১৩ উইকেট, এমন একজনকে ছাড়াই মাঠে নামতে হয় জেমকন খুলনাকে। খুলনা ফাইনাল নিশ্চিত করলো।
ফাইনালের আগে আরেকটি দু:সংবাদ। সাকিব আল হাসানকে ফিরতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। শ্বশুর তখন লড়ছিলেন তখন জীবন-মৃত্যুর সাথে। খুলনা তবুও হাল ছাড়ার পাত্র নয়।
এর মধ্যে বাবাকে কবরে রেখে ফিরেছেন শহিদুল। বুকে শোক চেপে ধরে তিন দিনের আইসোলেশনে ছিলেন। করোনা ভাইরাসের টেস্ট করে পান নেগেটিভ সার্টিফিকেট। ফাইনাল খেলতে কোনো বাঁধা নেই। নেমে পড়েন শহিদুল।
বাবা হারানোর তীব্র কষ্টটা বুকের ভেতর থেকে আগুন হয়ে বের হয় শহিদুলের। সেই আগুনের দেখা মেলে ফাইনালে। চার ওভারে দুই উইকেট নিয়ে ৩৩ রান গুণে শেষ করেন তিনি।
পরিসংখ্যান এক বিরাট গাধা। তার সাধ্য নেই শহিদুলের বোলিংকে ব্যাখ্যা করার।
শেষ ওভারে জিততে গাজী গ্রুপ চট্টগ্রামের দরকার ১৬ রান। ক্রিজে তখন দুই ‘সৈকত’। সৈকত আলী হাফ সেঞ্চুরি পেয়ে গেছেন। আর মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ১৯ তম ওভারের শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে চাপটা কমিয়ে রেখেছেন।
ফলে, বোঝাই যাচ্ছে – ম্যাচটা বের করে আনার সামর্থ্য দু’জনেরই আছে। কিন্তু, শহিদুলের মাথায় তো তখন অন্য পরিকল্পনা।
প্রথমটা ইয়র্কার। এক রান। সৈকত আলী থেকে থেকে স্ট্রাইকে আরেক সৈকত। পরেরটা দুর্দান্ত এক স্লোয়ার। সৈকতরা বের করতে পারলেন দুই রান। পাহাড় সমান চাপ তখন জমে হিমালয় হল। কারণ চার বলে করতে হবে আরো ১৩ রান।
তখন আরেকটা স্লোয়ার করলেন শহিদুল। একটু মিস টাইমিং, ফুলটস হল। কিন্তু, চেঞ্জ অব পেসটা ধরতে পারলেন না মোসাদ্দেক। ক্যাচ চলে গেল লং অনে দাঁড়ানো শুভাগত হোমের হাতে।
পরের বলে এগিয়ে এসে খেলতে গিয়ে বোল্ড হলেন নাহিদুল ইসলাম। খুলনার ডাগ আউটে উদযাপন শুরু হয়ে গেছে। পরের বলে আসলো দুই। শেষ বলে নাদিফ চৌধুরী ছক্কা হাকালেও তার দিকে ফিরেও তাকালো না চট্টগ্রামের ডাগ আউট। সবার চোখে মুখে তখন রাজ্যের হতাশা।
মধ্য মাঠে তখন চলছে খুলনার উল্লাস। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছেন, হাত মেলাচ্ছেন। অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে কয়েকজন মিলে রীতিমত কাঁধে তুলে ফেললেন।
সেই ভিড়ে শহিদুলও ছিলেন। সেই আনন্দ আয়োজনের ভিড়েও হয়তো টুর্নামেন্টে ১৫ টি উইকেট পাওয়া শহিদুলের চোখে তখন বাবার চেহারাটাই ভাসছিল!