১৯৯০-এর দশকের প্রথম ভাগ কলম্বিয়া ফুটবল ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৯০ ইতালি ফুটবল বিশ্বকাপ দিয়ে কলম্বিয়ার এই জয়যাত্রার সূত্রপাত। সিংহের মত একমাথা ঝাঁকড়া সোনালী চুল নিয়ে মাঝমাঠে দাপিয়ে খেলা কার্লোস ভালদেরামা বা নিজেদের পেনাল্টি বক্স থেকে একের পর এক বিপক্ষ ফুটবলারদের ড্রিবল করে প্রায় মাঝমাঠে এসে আক্রমণের ধার বাড়ানো ‘পাগলাটে’ গোলরক্ষক রেনে হিগুইতা তখন ফুটবল প্রেমী দর্শকদের কাছে দারুণভাবে জনপ্রিয়।
১৯৯০ বিশ্বকাপে শেষ ষোল-তে কলম্বিয়া-ক্যামেরুন ম্যাচে হিগুইতার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে ক্যামেরুনের রজার মিলার সেই গোল এবং তার ফলে সেই বিশ্বকাপ থেকে কলম্বিয়ার বিদায় হয়তো অনেকেই মনে রেখেছেন। কলম্বিয়ার এমন বিদায়ে দু:খিত হন নি, এমন ফুটবল প্রেমী বির । কিন্তু আরেকটি রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ হয়তো অনেকের মনে নেই।
১৯৯০ সালের ১৯ জুন। গ্রুপ ডির শেষ ম্যাচডে-তে মিলানে মুখোমুখি পশ্চিম জার্মানি ও কলম্বিয়া। নক আউট পর্বে যেতে হলে অন্তত: ড্র করতেই হবে কলম্বিয়াকে।পশ্চিম জার্মানি ইতোমধ্যেই পৌছে গেছে নক আউটে। কিন্তু খেলার শুরু থেকেই কলম্বিয়াকে রীতিমতো চেপে ধরে জার্মানরা। ক্লিন্সম্যান – ভয়লার- ম্যাথিউস- হাসলারদের ক্রমাগত আক্রমন সামলাতে জান দিয়ে লড়ছেন কলম্বিয়া ফুটবলাররা।
আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামানো হয় অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার লিটবারস্কিকে। দাঁতে দাঁত চেপে নির্ধারিত সময়ের খেলার প্রায় শেষ পর্ব পর্যন্ত জার্মানির আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পারলেও, খেলা শেষের ঠিক আগে, ৪৪ তম মিনিটে সব প্রতিরোধ ভেঙে গোল করে যান সেই লিটবারস্কি। হতাশায় ডুবে যায় গোটা কলম্বিয়া। কিন্তু শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়েনি মাঠে থাকা লাল- নীল জার্সির ১১ জন কলম্বিয়ান।
নির্ধারিত সময়ের শেষে ইনজুরি টাইমের খেলাও যখন প্রায় শেষ হয় হয়, মাঝমাঠে বল পেলেন ভালদেরামা। চার জন জার্মান ডিফেন্ডারকে টলিয়ে দিয়ে তার মাপা পাস জার্মান পেনাল্টি বক্সের সামনে এসে পরতেই, রাইট উইং থেকে উড়ন্ত পাখির ক্ষিপ্রতায় সেই বল ধরে এগিয়ে আসা জার্মান গোলরক্ষক বোরো ইলিগনরের দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে গোলার মত শটে গোল করে যান ১৯ নম্বর জার্সিধারী এক কলম্বিয়ান ফুটবলার।
সাথে সাথেই খেলা শেষের হুইসেল বাজান রেফারি। ১-১ গোলে ম্যাচ ড্র করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে যায় কলম্বিয়া। আর উৎসবে মত্ত কলম্বিয়ার দর্শকদের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব দেখে এক নতুন তারকার জন্ম হতে। পশ্চিম জার্মানি বা কলম্বিয়ার তাবড় তাবড় তারকাদের পিছনে ফেলে যিনি হয়ে উঠেছিলেন সেদিনের নায়ক, সেই ১৯ নম্বর জার্সির মালিক ফ্রেডি রিঙ্কন।
ফ্রেডি রিঙ্কন, নব্বই দশকের কলম্বিয়া ফুটবলে এক অন্যতম উজ্জ্বল নাম। ১৯৯০ থেকে ২০০১, দীর্ঘ এক দশকে দেশের জার্সিতে মাঠে নেমেছেন ৮৪ বার। এখনো পর্যন্ত কলম্বিয়া ফুটবল ইতিহাসে আর মাত্র আট জন ফুটবলার আছেন যারা তাঁর থেকে বেশি ম্যাচ খেলেছেন দেশের হয়ে। ১৯৯০ ইতালি, ১৯৯৪ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেশের হয়ে গোলও করেছেন ১৭ টি।
কলম্বিয়ার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় আছেন পঞ্চম স্থানে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে আর্জেন্টিনাকে তাদের ঘরের মাঠে ৫-০ গোলে পর্যুদস্ত করে কলম্বিয়া। সেই ম্যাচে কলম্বিয়ার প্রথম ও তৃতীয় গোলটি করেন তিনিই। কলম্বিয়ার অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ডও হাতে উঠেছিল তাঁর।
বিশ্বের নানা প্রথম সারির ক্লাবে খেলেছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে কলম্বিয়ার সান্তা ফে ক্লাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। এরপর কলম্বিয়ারই আমেরিকা দি কালি, ব্রাজিলের করিন্থিয়ানস, ইতালির নাপোলি বা স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদের মত ক্লাবের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। ক্লাবকে এনে দিয়েছেন একাধিক ট্রফি। করিন্থিয়ানসের হয়ে ২০০০ সালে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপও চ্যাম্পিয়ন হন।
অবসরের পর, নানা ছোট ক্লাবে বা যুব দলের কোচিং করিয়েছেন। তাঁর পুত্র সেবাস্তিয়ান রিঙ্কনও উঠতি ফুটবলার। ২০২২ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ৫৫ বছর বয়সে প্রয়াত হন এই কিংবদন্তি। তিনি সেই সব বিরল ফুটবলারদের একজন যারা তাঁদের জীবদ্দশাতেই বিদেশী দেশের ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছেন। ১৯৯৪ সালে নিকরাগুয়ার ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ফ্রেডি রিঙ্কনের সম্মানে। যদিও, জীবনের শেষ বেলায় ছিলেন একেবারে আড়ালেই।