বিশ্বকাঁপানো এক রোগা বালক

এক্কেবারে রোগা-পটকা এক ক্ষুদে বালক। সমবয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও হাড্ডিসার ছিলেন বলে সহজেই চোখে পড়তেন। বেড়ে উঠেছেন একটি খাঁটি ক্রীড়া পরিবারে। মা ইওনা পোল্যান্ডের হয়ে ভলিবল খেলতেন। আর বাবা ক্রজিসটফ পোল্যান্ডের নামকরা ফুটবল ক্লাব হুটনিক ওয়ারশের হয়ে ফুটবল খেলতেন, জুডোতে ছিলেন জুনিয়র ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন। 

তাছাড়া বাবা-মা দুজনেই শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। মায়ের পদচিহ্ন অনুসারী বোন মিলেনাও দক্ষ ভলিবল খেলোয়াড়হয়ে উঠলেন। এরকম একটি পরিবারে বড় হওয়া সেই বালক যে ক্রীড়াঙ্গনেই দ্যুতি ছড়াবেন তা সহজেই অনুমেয়। এই বালকটির নাম জানলে আপনি নিশ্চিত চমকে উঠবেন।

তাঁর নাম রবার্ট লেওয়ানডস্কি। সেইদিনের খাঁটো- হাড্ডিসার বালকটি বড়ো হয়ে বনে গেলেন ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার বিশ্বসেরা স্ট্রাইকার। আজ তো ফুটবলবিশ্বে লেওয়ানডস্কি এক বিস্ময়ের নাম!

লেওয়ানডস্কি বড় হয়ে তাঁর বাবার মতো হতে চাইতেন। তাঁর বাবা ক্রজিসটফ তাঁর সময়কালেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসম্পন্ন খেলোয়াড় হওয়াটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে থাকতেই লেওয়ানডস্কি বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল ও ফুটবলে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বাবার মতো ফুটবলকেই ভালোবেসে শেষমেশ আঁকড়ে ধরেছিলেন।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা মূলত তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিলো, সারাজীবন সেই স্বপ্নকে নিজের করে লালন করেছেন লেওয়ানডস্কি। ‘তুমি খুব ছোট, তুমি ফুটবলে পারবে না’ এই কথাটা তাঁকে সবাই বলতো।  কিন্তু লেওয়ানডস্কি জানতেন তিনি ঠিকই পারবেন, তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে তাঁকে পারতে হবে। 

২০০৫ সালের মার্চ মাসে অসুস্থতার কারণে যখন তাঁর বাবা মারা যান, যখন লেওয়ানডস্কির বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। বাবার মৃত্যু তাঁর জন্য ছিল বিরাট এক ধাক্কা। কিন্তু শোককে শক্তিতে পরিণত করে ফুটবলার হওয়ার দিকে তিনি আরও বেশি মনোযোগী হয়েছিলেন।

ডর্টমুন্ডে থাকাকালীন স্পোর্টবিল্ডকে লেওয়ানডস্কি একবার বলেছিলেন,যখন আমি অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ করি, তখন আমি নিজেকে বলি, আমি বাবার জন্য এটি করছি আমার জন্য এটা দারুণ অনুপ্রেরণা।’

লেজিয়া ওয়ারশ’র সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকাকালীন তিনি হাঁটুর ইনজুরিতে তিন মাসের জন্য খেলার বাহিরে ছিলেন। তখন লেজিয়া তাকে ২০০৬ সালের জুনে বাদ দিয়ে দেয়। বাবার মৃত্যুর পরপর এই ঘটনাটি ১৭ বছর বয়সী লেওয়ানডস্কিকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে এই ঘটনা তাঁর জীবনের সবচেয়ে খারাপ দিনগুলির মধ্যে একটি ছিল।

সেই সময়টায় লেওয়ানডস্কির মা তাঁকে দারুণ সমর্থন দিয়েছিলেন। লেওয়ানডস্কিকে এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি একজন গোলমেশিনে বনে গেলেন দ্রুতই। যা তাঁর দিকে সব ক্লাবের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছিল। বিশতম জন্মদিনের আগেই তিনি তার দেশ পোল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতে নেমে যান।

তিনি ২০০৯ সালে লেক পজনানের হয়ে পোলিশ কাপ এবং সুপারকাপ জিতেছিলেন এবং ২০০৯/১০ সালে লিগ শিরোপা জয় করেন। তিনি সেই মৌসুমের শীর্ষ স্কোরার ছিলেন। বাইশতম জন্মদিনের আগে ডর্টমুন্ডে যোগদান করেন তিনি। ২০১৪ সালে ডর্টমুন্ডের সাথে তার চুক্তির শেষ বছরটি বুন্দেসলিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে শেষ করেছিলেন। তারপর তিনি বায়ার্ন মিউনিখে যোগদান করেন।

রবার্ট লেওয়ানডস্কির সফল ক্লাব ক্যারিয়ারে বায়ার্নের হয়ে আটটি বুন্ডেসলিগা, তিনটি জার্মান কাপ, চারটি জার্মান সুপার কাপ জিতেছেন। এছাড়াও একবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একবার উয়েফা সুপার কাপ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। অর্থাৎ ২০১৪ তে বায়ার্নে যোগ দেয়ার পর থেকে সম্ভাব্য সব শিরোপা অর্জন করেছেন তিনি। প্রায় আট বছর সেখানে কাটানোর পর এই ক্লাব ছেড়ে সম্প্রতি বার্সেলোনায় যোগ দিয়েছেন এই পোলিশ তারকা।

রবার্ট লেওয়ানডস্কি সাতবার পোল্যান্ডের বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড করেছেন।  দু’বারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের তকমাও জুটিয়েছেন তিনি। সবমিলিয়ে সামনে এখনো অপার সম্ভাবনার প্রহর অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। এই ফুটবল বিস্ময় বার্সেলোনায় হয়ে আর কি কি রেকর্ড গড়েন তা দেখতে মুখিয়ে আছে ফুটবল বিশ্ব।

তবে, লেওয়ানডস্কি এবার গর্ব করে বলতেই পারেন তিনি বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছেন। বিশ্ব ফুটবলের আন্তর্জাতিক তারকার কাতারে একেবারে প্রথম দিকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সেদিনের সেই রোগা ছেলেটাকে আজ লোকে জানে রবার্ট ‘লণ্ডভণ্ডস্কি’ নামে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link