অপ্রতিরোধ্য বোথাম
প্রচলিত আছে একবার এক সাংবাদিক বোথামের সতীর্থ এক ক্রিকেটারকে বলেছিলেন যে বোথামের ক্রিকেট হচ্ছে এমন এক মোমবাতির সঙ্গে তুলনীয় যার দুই দিক আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। উত্তরে সেই ক্রিকেটার বলেন, ‘না, সে সেই মোমবাতিকে দুই টুকরো করে দুটোরই দুই দিকে আগুন জ্বালিয়ে চারটে মোমবাতির আলো বিকিরণ করে চলেছে।’
১৯৭৩ সালে নিউজিল্যান্ড থেকে রোগা ছিপছিপে, ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী এক ফাস্ট বোলার টেস্টের আঙিনায় প্রবেশ করেন। তাঁর শুরুটাও তেমন সুবিধের হয়নি। জীবনের প্রথম পাঁচ টেস্টে এর মোট উইকেট সংগ্রহ ১০, উইকেট প্রতি ৫১ রান বিলিয়ে। ব্যাট হাতে গড় ১৫’র চেয়েও কম। এই ছেলেটি যে এক সময় বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারের স্থান দখল করবেন এমন সন্দেহ করার কোন কারণ ছিল না। ইনিই প্রবাদপ্রতিম স্যার রিচার্ড হ্যাডলি।
তবে সব অলরাউন্ডাররাই ইমরান বা হ্যাডলির মতো ঢিমে তালে ক্যারিয়ার আরম্ভ করে পরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন এমন ভাবার কারণ নেই। এবার যে ক্রিকেটারকে নিয়ে আলোচনা করব তার মতো বিস্ফোরক আবির্ভাব টেস্ট ক্রিকেটের মঞ্চে এর আগে বা পরে ঘটেনি। ইনি ব্রিটিশ সিংহ ইয়ান ট্যারেন্স বোথাম।
১৯৭৭ সালে টেস্ট খেলা আরম্ভ করেন বোথাম। প্রথম টেস্টেই ইনিংসে ৫ উইকেট নেন। এরপর ১০০ আর ২০০ উইকেট আসে যথাক্রমে ১৯ এবং ৪১ তম টেস্টে। সেই সঙ্গে ব্যাট হাতেও বথাম সমান বিধ্বংসী। পঞ্চাশ টেস্ট খেলার আগেই দশ খানা সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন বোথাম, যা যে কোন প্রথম সারির ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তুলনীয়। তুলনা দিচ্ছি – শচীন টেন্ডুলকারের দশম সেঞ্চুরি আসে ৪১ তম টেস্টে, লারার ৪৫তম। এমন কি এটাও বলা যায় যে ক্রিকেট জীবনের প্রথম ৪০-৫০ টেস্টে ইয়ান বথামের মতো সাফল্য আর কোন ক্রিকেটার পান নি। এমন কি স্যার ডনকেও এই ব্যাপারে পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন বোথাম।
কথাটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? দেখা যাক।
স্যার ডন মোট ৫২টি টেস্ট খেলে প্রায় সাত হাজার রান সংগ্রহ করেন। এবার আমরা দেখব বোথামের পাওয়া উইকেটকে রানের পরিবর্তন করলে তার জীবনের প্রথম ৫২ টেস্টের পর তিনি কোথায় থাকেন।
টেস্টে একটা উইকেট অন্তত ২০ রানের সমান মুল্যবান (একটা স্ট্যাটিস্টিক্যাল হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা ২৫ হবে তবু ইনিংসে ৫ উইকেট আর সেঞ্চুরি কে সমমর্যাদার স্থান দিয়ে আমি ব্যাটসম্যানদের অর্থাৎ স্যার ডনকে একটু ফেভার করলাম)। ৫২ টেস্টের শেষে ২৩৭ উইকেট নেন বোথাম। সংখ্যাটাকে ২০ দিয়ে গুণ করলে আমরা পাবো ৪৭৪০ রান। এর সঙ্গে এবার যদি ৫২ টেস্টের পর বথামের করা ২৮৩৫ রান যোগ করা হয় তাহলে আমরা পাবো মোট ৭৫৭৫ রান যা স্যার ডনের ৬৯৯৬ এর চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি।
বা উল্টোটা। টেস্ট ক্রিকেটে বল হাতে সবচেয়ে অভাবনীয় স্ট্রাইক রেট ছিল সিডনি বার্নস নামের এক ব্রিটিশের। মোট ২৭ টেস্টে ১৮৯ উইকেট নেন বার্নস, টেস্ট পিছু সাত খানা উইকেট। অনেকেই ওনাকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বোলারের শিরোপা দিয়ে থাকেন। ২৭ টেস্টের পর ব্যাট হাতে বথামের সংগ্রহ ১৪০৫ রান, বল হাতে ১৪৬ উইকেট।
আমরা যদি বোথামের রানকে ২০ দিয়ে ভাগ করে উইকেটে পরিবর্তিত করে তার সঙ্গে বোথামের উইকেট যোগ করি তাহলে বোথামের উইকেট সংখ্যা দাঁড়াবে ২১৬টি উইকেট, বার্নসের চেয়েও ২৯টি বেশি, টেস্ট পেছু অকল্পনীয় আট খানা করে উইকেট।
তবে নিছক পরিসংখ্যান নয়, বোথামের ক্রিকেটের মূল আকর্ষণ ছিল তার খেলার ধরন। ব্যাট হাতে নিজের দিনে বথাম প্রায় ভিভ রিচার্ডসের মতোই বিধ্বংসী ছিলেন। ড্রাইভ, হুক, পুল, কাট – ক্রিকেটের সব ধরনের স্ট্রোক ছিল বোথামের হাতে।
সেই সঙ্গে বল হাতেও একটা দলকে একাই শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। ক্যারিয়ারের আরম্ভের দিকে যথেষ্ট গতির সঙ্গে সঙ্গে স্যুইংয়ের ওপরও অসাধারণ নিয়ন্ত্রন ছিল তাঁর। প্রায়ই দেখা যেত ব্যাটিং আর বোলিং দুটোতেই অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে প্রায় একাই ম্যাচ জেতাচ্ছেন বোথাম।
প্রচলিত আছে একবার এক সাংবাদিক বোথামের সতীর্থ এক ক্রিকেটারকে বলেছিলেন যে বোথামের ক্রিকেট হচ্ছে এমন এক মোমবাতির সঙ্গে তুলনীয় যার দুই দিক আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। উত্তরে সেই ক্রিকেটার বলেন, ‘না, সে সেই মোমবাতিকে দুই টুকরো করে দুটোরই দুই দিকে আগুন জ্বালিয়ে চারটে মোমবাতির আলো বিকিরণ করে চলেছে।’
বোথামের কিছুদিন পরেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল ভারতের টেস্ট ক্রিকেট টিমে। এক লম্বা, ছিপছিপে ছোকরা বল হাতে বেশ অনেকটা ছুটে এসে বিপক্ষের ওপেনারদের উদ্দেশ্যে বাউন্সার বর্ষণ করছে। বহুদিন (নাকি বহুযুগ?) পরে দেখা গেল আমাদের একজন ফাস্ট বোলারের বাউন্সারে ডাক করছেন বিপক্ষের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। চেয়ে পাঠাচ্ছেন হেলমেট।
তবে বল নয়, কপিলদেব ক্যারিয়রের আরম্ভে বেশি সাফল্য পান ব্যাট হাতে। এতটাই যে মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই সাহেবরা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হন। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তারা মেনে নেন যে ইয়ান বথামের সামনে চ্যালেঞ্জের দস্তানা ছোঁড়ার লোক এসে গেছে।
বথামের মতোই কপিলও ব্যাট হাতে বড় বড় বোলারদের গ্যালারীতে পাঠাতেন অবলীলায়, বল হাতে ছিলেন ভারতের ‘ওয়ান ম্যান ডেমলিশান আর্মি’। মাত্র ২৫ টেস্টে ‘ডাবল’ (১০০০ রান, ১০০ উইকেট) এবং ৫০ টেস্টে ‘ডাবল ডাবল’ (২০০০ রান, ২০০ উইকেট) পূর্ণ করেন কপিল। টেস্টের সংখ্যায় বোথামের পেছনে তবে বয়স এবং সময়ের দিক দিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে দ্রুততম।