ব্যক্তিপূজায় জর্জরিত ভারতীয় ক্রিকেট

দ্বিতীয় রাউন্ডের কেবল একটি মাত্র ম্যাচ জিতেছিল ভারত। এশিয়া কাপের মত একটা আয়োজনে ভারতের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। আট বারের চ্যাম্পিয়ন তারা। তবুও ২০২২ এশিয়া কাপটায় সব হিসেবে লেগে যায় গোলমাল। প্রথম রাউন্ডের সব ম্যাচ জিতেও শেষমেশ জেতা হল না শিরোপা। কিন্তু অদ্ভুত কারণে ভারতের এমন ব্যর্থতা নিয়ে তেমন কোন আলোচনার হয়নি।

হয়নি বললেও আসলে ভুল বলা হয়। বরং তা চাপা পড়ে যায় বিরাট কোহলির শতকে। হ্যা, প্রায় হাজারের বেশি দিনের অপেক্ষা শেষে তিনি পেয়েছেন সেই অধরা শতক। আর সে শতকের প্রশংসা ছাপিয়ে যায় ভারতের এশিয়া কাপ ব্যর্থতাকে। আর ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই অভিযোগ রয়েছে ভারতের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীরের। তিনি ভারত ক্রিকেটের এই ‘ব্যক্তিপুজা’ সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসার পরামর্শও দিয়েছেন।

এশিয়া কাপের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে বিরাট তুলে নিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম টি-টোয়েন্টি শতক। সে ম্যাচে ভারত একটা বিশাল বড় জয় পেয়েছে সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে সেদিনের বড় জয়ে বিরাটের সমপরিমাণই অবদান রেখেছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। তিনি চার ওভার বল করে তুলে নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট। আর তাতেই তো নিশ্চিত হয়েছিল ভারতের বিশাল বড় জয়।

তবে বিরাটকে নিয়ে যতটা বন্দনায় ভেসেছিল গোটা ভারতসহ পুরো ক্রিকেট বিশ্ব, তার ধারেকাছের আলোচনাও হয়নি ভুবনেশ্বরের ফাইফার নিয়ে। এই বিষয়টি নিয়েও চাপা ক্ষোভ রয়েছে গৌতম গম্ভীরের। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বলেন, ‘যেদিন বিরাট শতক হাঁকাল সেদিন মিরাটের ছেলে ভুবনেশ্বরও পাঁচ উইকেট বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কেউ একটিবার তাঁর বিষয়ে আলাপ করবার চিন্তাও করল না। ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় একমাত্র আমি তাঁর সেই পারফরমেন্সের বিষয়ে কথা বলেছিলাম। সে চার ওভার বল করে পাঁচ উইকেট বাগিয়ে নিয়েছিল। মনে হয়না সেটা কেউ জানে।’

ভারতের সবাই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বিরাটের শতক নিয়ে। সে বিষয়ে গম্ভীর আরও যোগ করেন, ‘বিরাট শতক করার পর দেশের সবখানেই উৎসব শুরু হয়ে যায়। ভারতের এই ধরণের ব্যক্তিপুজা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।’ তবে এই যে ব্যক্তিপুজা বিষয়টা কখনোই তো আর নতুন কিছু নয়। খোদ ভারত ক্রিকেটের উদাহরণে এই ব্যক্তি পুজার ঘটনাটা বহুবার সামনে এসেছে। সুনীল গাভাস্কার থেকে শুরু করে কপিল দেব, শচীন টেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি।

ক্রমে ক্রমে এই খেলোয়াড়দের নিয়ে আলাদা করে আনন্দ উৎসবে সব সময়ই মেতেছে ভারতের ক্রিকেট। এদের সামান্য অর্জনও ফলাও করে জায়গা করে নিয়েছে ভারতের মূল ধারা গণমাধ্যমে। শুধু ভারত নয়। এমন উদাহরণ বাংলাদেশেও খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বিষয়টাই তো সবচেয়ে বড় উদাহরণ। পঞ্চপাণ্ডবের নূন্যতম অর্জনকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের উন্মাদনার যেন কোন শেষ নেই।

এই বিষয়টা থেকে খুব সহসাই পরিত্রাণের উপায় তো নেই। বিশ্বের ক্রীড়াঙ্গনেও এমন উদাহরণ ভুড়িভুড়ি। লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোদের ব্যক্তিগত অর্জন ছাপিয়ে গেছে দলগত যেকোন অর্জন। ব্যক্তি নিয়ে এমন মাতামাতি সম্পূর্ণ ক্রীড়াঙ্গন জুড়েই রয়েছে। কোন এক ব্যক্তিতে মুগ্ধ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তারা তেমনই ক্যারিশম্যাটিক। তাইতো তাদের নিয়ে হয় আলোচনা।

তবে এই আলোচনার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হল, এই যে বাজে পারফরমেন্সের উপর একটা পর্দা পড়ে যাওয়া। সম্ভবত গৌতম গম্ভীর ভারত দলের বর্তমান পারফরমেন্স নিয়ে বেশ চিন্তিত। আর এই বাজে পারফরমেন্সের সমালোচার চাইতে কোন ব্যক্তিগত খেলোয়াড়েরকে নিয়ে বাড়তি উন্মাদনা ভাবাচ্ছে তাঁকে ভারত ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। নিজের জায়গা থেকে গৌতম গম্ভীরের এমন দুশ্চিন্তা বড্ড স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, ভারত কি পারবে এমন ব্যক্তিপুজা থেকে বের হতে? অথবা গোটা বিশ্ব?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link