সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার উইকেট শিকারীদের তালিকায় চোখ বোলাতে গিয়ে একটা ব্যাপার দেখে বেশ আশ্চর্যই লাগলো। যেটা হলো – টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার পেসারদের পারফরমেন্স। গত ২৫ বছরের নিরিখে দেখতে গেলে দেখা যাচ্ছে চামিন্ডা ভাস ছাড়া মাত্র ৩ জন শ্রীলঙ্কান পেসার টেস্টে ১০০ উইকেটের সীমানা পার করেছেন, এরা হলেন দিলহারা ফার্নান্দো, লাসিথ মালিঙ্গা ও সুরঙ্গা লাকমাল।
এরমধ্যে শেষ জন ভাসের অবসরের পরে পেসারদের ব্যাটন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেন ১৭১ উইকেট দিয়ে, এদিকে দিলহারা ও মালিঙ্গার টেস্ট জীবন ওই ১০০ উইকেটের আশেপাশেই শেষ হয়। এর মাঝে অনেক পেসার এসেছেন গেছেন, কিন্তু তাঁদের উইকেট সংখ্যা ওই ৭০-৮০ এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণ কী? একটা হতে পারে ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এর পেসারদের মত এঁরা সেনা দেশ গুলোতে তুলনায় অনেক কম টেস্ট খেলেন এবং দেশের মাঠে একদম স্পিনিং ট্র্যাকেই বেশি খেলেন। কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার হচ্ছে বাকি শ্রীলঙ্কা পেসারদের ধারাবাহিকতার অভাব।
কারণ, একই সমস্যা গুলো তো চামিন্দা ভাসের ও ছিল। তাঁর সময় ও দেশের মাঠে পিচ বানানো হত মুরালির কথা ভেবেই কিংবা বিদেশের মাটিতে লম্বা টেস্ট সিরিজ খুবই কম খেলেছেন। কিন্তু এর মধ্যেও চামিন্ডা ভাস পেরেছেন। নয় নয় করে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর উইকেট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৫, যা তাঁর সমসাময়িক সব শ্রীলঙ্কা পেসারদের উইকেট সংখ্যা মেলালেও সমান হবে না।
এবার কথা হচ্ছে ভাস পারলেন কী করে? নিজের জেদ, একই জায়গায় টানা বল করে যাওয়ার ক্ষমতা, ইনিংসের শুরুতে দুদিকে সুইং কিংবা পরের দিকে রিভার্স সুইং এবং সবশেষে দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা। একটা সামান্য তথ্য দিলে ব্যাপারটা অনেকটাই পরিষ্কার হবে – ভাস নিজের ক্যারিয়ারের একদম অর্ধেক টেস্ট ৫৬ টা খেলেছেন দেশের মাটিতে এবং সেখান থেকে তুলে নিয়েছেন ১৮০ টা উইকেট!
অর্থাৎ মুরালি, হেরাথ, জয়াসুরিয়াদের বিচরণভূমিতে ভাস একটুও পিছিয়ে নেই। অর্থাৎ এখানেই তিনি পেসার হিসেবে অনন্য, বিদেশের মাটিতে সর্বত্র যে ভাস দারুণ সাফল্য পেয়েছেন তা কিন্তু নয়, একটা ক্যানবেরা টেস্ট বাদে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কিংবা ভারত, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে কিন্তু চামিন্দার টেস্ট পারফরমেন্স সাদামাটা বলা যায়। যদিও শুধু এটুকু দিয়ে ভাসকে বিচার করলে সেটা হয়তো অন্যায়ই হবে।
এখনও মনে পড়ে ২০০১ এ সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের শ্রীলঙ্কা সফর, যেখানে লারা প্রতি টেস্টে নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন মুরালির ঘরের মাঠে, লারা -মুরলী দ্বৈরথ এক দারুণ সিরিজ উপহার দিয়েছিলো, এর মধ্যে চামিন্দার নি:শব্দে ৩ টেস্টে ২৬ উইকেট!
কিংবা মনে পড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটা টেস্ট ক্যালিসকে একপ্রকার ফাঁদে ফেলে আউট করাটা, কী রকম – দিলশানকে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট থেকে তৃতীয় স্লিপে এনে ঠিক একটা বল পরেই ওই দিলশানের হাতেই ক্যাচ তুলতে বাধ্য করা।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নিউজিল্যান্ড সফরে সেবার তিনটে ইনিংস বল করে ৩ বারই ৫ উইকেট পেয়েছিলেন। দুদিকেই তখন বল সুইং করাচ্ছেন, কথা বলাচ্ছেন ভাস নিজের ইচ্ছে মত। ক্যারিয়ার যত এগিয়েছে রিভার্স সুইং টাও দারুণ ভাবে রপ্ত করেছেন, পরবর্তীকালে জহির খানকে দেখেছি অনেকটাই ভাসের মত রিভার্স সুইং করাতে।
শুরুর দুটো বছর আর মাঝে ২০০০ সালের শেষ দিক থেকে ২০০৫ সাল মোটামুটি চামিন্দা ভাসের ক্যারিয়ারের সেরা সময়। পরবর্তীকালে পেসটা অনেকটাই কমে যায়, শেষ দুই বছর কিপারকে সামনে এনেও বোলিং করেছেন, পরে বয়সের সাথে ফর্ম হারিয়েছেন।
কিন্তু, আজও ভাবতে অবাক লাগে সাড়ে তিনশো টেস্ট উইকেটের মাইলস্টোনে পৌঁছানো বোলার কিন্তু টেস্ট বোলার হিসেবে ‘আন্ডাররেটেড’ই থেকে গেলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর অসাধারণত্ব নিয়ে অনেকে গল্পের খাতা খুললেও টেস্টে ভাসের পারফরমেন্স কোথাও যেন নীরবে মাটি চাপা পড়ে যায়।
হয়তো তিনি শ্রীলঙ্কান পেসার বলে, হয়তো ক্রিকেটের কুলীন দেশে দুর্ধর্ষ ম্যাচ জেতানো স্পেলের অভাব থাকায়, কিন্তু দিনের শেষে লঙ্কা ক্রিকেটের পেস সংসার যে চামিন্দা একার হাতে প্রায় ১৫ বছর বহন করে গেছেন, এটা সিংহলিজ স্পোর্টিং ক্লাবের ঘাস গুলোই বোধহয় নীরব সাক্ষী হয়ে থেকে গেছে।