২০০৬-০৭ এর দিকে যখন প্রথম ক্রিকেট দেখা শুরু করি, তখনকার ভারত দলের নামী সুইং বোলার আর পি সিং। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী ভারত দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। যতদিন খেলেছেন, বিশেষত নতুন বলে খুব ভালো নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের এই বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার।
তার আগে উত্তর প্রদেশের আরেকজন ফাস্ট বোলার বোলিং উদ্বোধন করেছেন ভারতের হয়ে। আর পি সিংয়ের মতো তিনিও ছিলেন বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার। কাকতালীয়ভাবে তারও নাম ছিল আর পি সিং, অর্থাৎ রুদ্র প্রতাপ সিং। মাত্র দুটো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা আর পি সিং রয়ে গেছেন বিস্মৃত নাম হয়ে, কেননা তার উত্তরসূরি আর পি সিং ছিলেন তার চাইতে অনেক বেশি সফল।
আর পি সিং জুনিয়রের মতো স্মরণীয় কিছু করতে পারেননি, তবে একটা বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের তৃতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় আর পি সিং সিনিয়রের। টস জিতে ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব ব্যাটিংয়ে পাঠান অজিদের। অধিনায়ক প্রথম ওভার করার পর অপর প্রান্তে বোলিংয়ে আনেন আর পি সিংকে। এটা ছিল কয়েকটি বিরল ঘটনার একটি, যেখানে বোলিং উদ্বোধন করা দুই বোলার জন্মদিনই ছিল একই দিনে।
অবশ্য এটাই প্রথম দৃষ্টান্ত ছিল না এমন ঘটনার। এর আগে জুটি বেঁধে বোলিং করা ইংল্যান্ডের স্পিনারযুগল ডেরেক আন্ডারউড ও রে ইলিংওয়ার্থ এবং নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বোলারযুগল স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও ইওয়েন চ্যাটফিল্ডেরও জন্মদিন ছিল একই দিনে।
স্যার রিচার্ড হ্যাডলির নামটা যতটা না পরিচিত, ততটাই অপরিচিত ইওয়েন চ্যাটফিল্ডের নাম। ক্যারিয়ারজুড়ে ছিলেন হ্যাডলির ছায়া হয়ে।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, একজন চ্যাটফিল্ড না থাকলে রিচার্ড হ্যাডলি হয়তো রিচার্ড হ্যাডলি হয়ে উঠতে পারতেন না। দীর্ঘ সময় ধরে একই জায়গায় বোলিং করে চাপ প্রয়োগ করতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। ৪৩ টেস্টে ১২৩ উইকেট আর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিয়েছেন ১১৪ ম্যাচে ১৪০ উইকেট।
জাভেদ মিয়াঁদাদ তার আত্মজীবনীতে চ্যাটফিল্ডকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘হিউম্যান বোলিং মেশিন’ নামে।
তবে এতকিছু হতোই না যদি নিজের অভিষেকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসতে না পারতেন চ্যাটফিল্ড। কনকাশন নিয়ে গত কয়েকদিন খুব আলোচনা হচ্ছে, তাই ঘটনাটা লিখে ফেলছি।
অ্যাশেজ শেষে ১৯৭৫ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ায় রান খরা কাটিয়ে অবশেষে রানে ফেরেন ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা। অকল্যান্ড টেস্টে ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে ৬ উইকেটে ৫৯১ রান করে।
নিউজিল্যান্ড অলআউট হয় ৩২৬ রানে, ফলো-অনে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ দিন বিকেলে ১৪০ রানেই ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলে ব্ল্যাক ক্যাপরা। ১১ নম্বরে নামা অভিষিক্ত বোলার চ্যাটফিল্ড আর জিওফ হাওয়ার্থ কোনোমতে শেষ বিকেলটা কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
হাতে বাকি কেবল একটাই উইকেট। ইংল্যান্ডকে আরেকবার ব্যাট করাতে নিউজিল্যান্ডের দরকার ১০৫ রান। টেস্টের চতুর্থ আর পঞ্চম দিনের মাঝের দিন ছিল ‘রেস্ট ডে’। অবশ্যম্ভাবী ইনিংস ব্যবধানে জয়টা এই রেস্ট ডেটা দীর্ঘায়িত করলো, তাই কিছুটা হতাশাই বিরাজ করছিল ইংরেজ শিবিরে।
শেষদিন প্রথম ৩৫ মিনিট শুধু নির্বিঘ্নেই কাটালেন না হাওয়ার্থ আর চ্যাটফিল্ড, যোগ করে ফেললেন আরও ৪১ রান। ইংরেজদের অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হতেই থাকল।
এর মাঝে ইংরেজ ফাস্ট বোলার পিটার লিভারের বলে শর্ট লেগে প্রায় ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন চ্যাটফিল্ড। লিভার ভাবলেন, এভাবেই আউট করবেন তাকে। ব্যাটের কাছে তাই দুটো ফিল্ডারকে ডেকে আনলেন লিভার।
দিনের পঞ্চম ওভারের পঞ্চম বলটা ছিল খাটো লেন্থের। চ্যাটফিল্ড কোনো মতে সরিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু বলটা তার গ্লাভসে লেগে মাথার বাঁ দিকে আঘাত করল। কয়েক সেকেন্ড পরেই মাটিতে পড়ে গেলেন চ্যাটফিল্ড।
১ নম্বর স্ট্যান্ডে বসে ছিলেন ইংল্যান্ড দলের ফিজিও বার্নার্ড থমাস। তিনি প্রথমে ভাবলেন, এটা নিউজিল্যান্ড দলের সমস্যা, তাই তাদের সমস্যা তারাই দেখুক। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারলেন যে, মাঠে কোনো চিকিৎসক নেই। ফিল্ডারদের চিৎকার শুনে থমাস উপলব্ধি করতে পারলেন যে, যা ভেবেছিলেন তার চাইতে গুরুতর কিছুই ঘটেছে।
থমাস ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলেন যে, চ্যাটফিল্ডের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং তার হৃদস্পন্দনও হচ্ছে না। মাঠে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রপাতিও নেই। মুমূর্ষু চ্যাটফিল্ডকে বাঁচানোর তাই একটাই উপায় ছিল এবং ফিজিও থমাস সেটাই করলেন।
মুখে মুখ লাগিয়ে চ্যাটফিল্ডের জন্য কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করলেন থমাস। সঙ্গে যে অ্যাম্বুলেন্সম্যান ছিলেন, তিনি পরে বলেছিলেন, ‘আমরা তখন সেখানে না পৌঁছলে চ্যাটফিল্ডকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।’
এতকিছু যখন চলছে, তখন এই ঘটনার পেছনে থাকা বোলার পিটার লিভার হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে কাঁদতে শুরু করেছেন। কিছু দর্শক মাঠে নেমে ঘিরে ফেলেছিল তাঁকে।
যা হোক, থমাসের চিকিৎসায় বিপদমুক্ত হলেও জ্ঞান তখনো ফেরেনি চ্যাটফিল্ডের৷ স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাবার পর চ্যাটফিল্ডকে হাসপাতালে নিয়ে যান থমাস। কাঁদতে কাঁদতে স্ট্রেচারের পেছন পেছন মাঠ ছাড়েন লিভার।
সেদিন দু’বার হাসপাতালে গিয়েছিলেন লিভার। একবার চ্যাটফিল্ডের জ্ঞান ফেরার আগে, আরেকবার পরে। দ্বিতীয়বার হাসপাতালে যাবার পর চ্যাটফিল্ড তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘তোমার দোষ ছিল না।’
চ্যাটফিল্ড খুব জোরে বল করতেন না, বলেছিলেন, ‘আমি কখনো বাউন্সার করিনি, সেরকম গতি আমার ছিল না।’
নাকি বাউন্সারের শিকার হয়ে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার কারণেই কখনো বাউন্সার দেবার কথা ভাবেননি? কে জানে?