চট্টগ্রামের বাতাসেই ছিল বিদায়ের গন্ধ

খান সাহেব, কান্না জড়ানো কণ্ঠেই বলে দিলেন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা ওয়ানডে ম্যাচটাই ছিল তাঁর শেষ। কোলাহল নিমিষেই নিশ্চুপ। গোটা হলরুম জুড়েই নিস্তব্ধতা। শুধু ক্যামেরায় স্থির চিত্র বন্দী হওয়ার আওয়াজ। বেদনাতুর মিনিট ১৫, দেড় দশক মনে হতে লাগল। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারটার শেষ পাতায় একরাশ দীর্ঘশ্বাস, আর অনুজদের জন্য একটু স্বস্তির আহবান।

যেই চট্টগ্রাম থেকে শুরু, সেখানেই শেষ। খান পরিবারের ছোট ছেলেটাও ইতি টেনে নিল তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। চট্টগ্রামে পা রাখার পর থেকেই যেন বাতাসে কেমন একটা গুমোট পরিস্থিতি। কিন্তু তেমন তো হওয়ার কথা ছিল না। টেস্টে আফগানিস্তানকে রীতিমত উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর তো স্রেফ উড়ে বেড়ানোর কথা।

কিন্তু উড়তে দেখা গেল না তামিম ইকবালকে। যেন এক ক্লান্ত পথিক হয়ে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। প্রথম যেদিন গণমাধ্যম সুযোগ পেল বাংলাদেশের অনুশীলন পর্যবেক্ষণ করবার, সেদিনও কোথাও একটা আড়ালে থেকে গেলেন তামিম ইকবাল। খানিকক্ষণ অবশ্য ব্যাটিং অনুশীলন করলেন। তবে সেটুকু অবসরে করা অনুশীলন ঠেকলো।

তখনও হয়ত কেউ আন্দাজ করতে পারেনি যে, ঠিক কতটা মানসিক চাপ তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন। কতশত চিন্তার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাথে শরীরের অস্বস্তি তো রয়েছেই। মানুষের মনের অসুখ হলে নাকি তা বোঝা যায়। চোখ দু’টো বিষন্নতার পরিচয় দেয়। সেই ছবিটাই পাওয়া গেল আফগানদের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডের আগের দিন।

তখনও সংবাদ সম্মেলনে হাজির। তামিম বেশ চেপে যাওয়ার চেষ্টাই সম্ভবত করছিলেন। নিজের শেষের সিদ্ধান্তটা তখনও বোধহয় বুক পাঁজরের সিন্দুকে আটকে রেখেছিলেন। তিনি শুধু একটিবার নিজের ঘরের মাঠে খেলে যেতে চাইলেন। পিঠের ব্যথাটা যেন তাকে আর লড়াই করতে দিতে চাইলছিল না। আবার হয়ত তার পরিবেশ তাকে সাহস জোগাতে হয়েছিল ব্যর্থ।

তবে তিনি জানালেন, পুরোপুরি ফিট নন। তবুও খেলবেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে। তা নিয়ে তো গোটা দেশজুড়ে হাসি-ঠাট্টা আর সমালোচনার রোল পড়ে গেল। তখনও নিশ্চয়ই কেউ আন্দাজ করতে পারেনি, লর্ডসের বুকে নিজের নাম লিখে আসা ছেলেটাকে আর দেখা যাবে না টেলিভিশনের পর্দায়। তাকে নিয়ে হওয়া নিন্দার ঝড় আর বইবে না।

তামিম কাউকেই বুঝতে দিলেন না। তিনি চুপিসারে নিজেকে শেষ বারের মত বাজিয়ে দেখলেন। ম্যাচের দিন বৃষ্টির ছেলেখেলার আগে তামিম নেমেছিলেন জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে। খানিকটা গা গরম করে নিতেই। এরপর সময় হলো, বেলা ১:৩০ এ হবে টস। তাইতো তামিম পথ ধরলেন সাজঘরের। বেশ ধীরেই তিনি হেঁটে গেলেন। বারেবারে পিছন ফিরে চাইলেন।

সম্ভবত পেছনে ফেলে আসা ক্যারিয়ারটাই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তখন। মিনিট পাঁচেক পর তামিমের আগমন। সম্মানের সেই লাল-সবুজ জার্সিতে। শেষবারের মত। তখন কি কেউ বুঝেছিল? তামিম শতভাগ সফল। নিজের মনের ভেতর চলা ঝড়-তুফান অনায়াসে তিনি লুকিয়ে গেলেন। দৃপ্ত পায়ে দাপিয়ে বেড়ানো ছেলেটার চলনে কেমন এক ক্লান্তির ছাপ।

টস হলো, নিজের শেষ টসটায় হেরে গেলেন তামিম। ভাগ্য বোধহয় এমনই। কঠিনতম সময়গুলোতে বারেবারে বিপরীতেই চলে যায়। সে যাক গে, বেলা দু’টো বাজতেই সাগরিকার সিড়ি বেয়ে নেমে এলেন। ক্রিকেটীয় মুকুট আর হাতে থাকা তরবারী নিয়ে। তিনি হয়ত খুব করে চাইছিলেন কোন এক মহাকাব্যিক সমাপ্তি। তার আর হলো না। ঐ যে নিষ্ঠুর ভাগ্য। আপনি যা চাইবেন, তা কখনোই আপনাকে দেবে না।

তামিমের সাথে হলোও তাই। তামিম দ্রুতই আউট হয়ে ফিরে গেলেন। এরপর শুধুই অপেক্ষা। সিদ্ধান্ত সম্ভবত বোর্ডকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হোসেন পাপন গণমাধ্যমে কথা বলবেন, এমন একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে ছিল প্রেসবক্সে। তিনিও আর মিডিয়ামুখো হলেন না। চট্টলার বৃষ্টি শুধু কালক্ষেপনই করেছে। বাংলাদেশ হেরেছে।

সবার আগে টিম বাসে উঠেছেন তামিম। সবকিছু যেন এড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। বিষাদের মুহূর্তে তো কোনকিছুতেই তো আর মনে বসে না। তিনি ফিরলেন টিম হোটেলে। সতীর্থদের থেকে বিদায় সম্ভবত নিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। এরপরই চুপিসারে গণমাধ্যমকে জানালেন তিনি কিছু একটা বলবেন। প্রথমে বেলা ১২টার কথাই জানালেন। কিন্তু তখন কোথাও হবে তার শেষ সংবাদ সম্মেলন, সেটা যেন সবারই অজানা।

উৎকণ্ঠা পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিকদের মস্তিষ্ক জুড়েই তখন নানান সমীকরণ মিলানোর প্রয়াস। সবাই তখন হন্যে হয়ে একটা উত্তর খোঁজার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। সময় যেন থমকে গেল। কিছুতেই যেন সময় আর যেতে চাইছে না। অবশেষে ঘড়ির ছোটকাটা যখন একের ঘরে প্রবেশ করল, তখনই কালো রঙের এক গাড়ি থেকে নেমে এলেন তামিম। বিষাদের রঙ ধূসর, তবে এদিন পুরো চট্টগ্রাম জুড়েই শোকের রঙের দখল।

তামিমের আগমনের সাথে সাথে ঘন কালো মেঘে ঢেকে যায় নিলাম্বর। তামিম স্থানীয় হোটেলের হল রুমে ঢুকলেন, সেখানেই সংবাদ সম্মেলনের বন্দোবস্ত। চোখ জুড়েই তখন নোনা জল বেয়ে পড়ার অপেক্ষা। বিদায় বেলায় সম্ভবত কোন এক উপন্যাস পড়ে শোনাতে চাইলেন তিনি। তবে পারলেন কই? নোনা জল গড়িয়ে ভিজিয়ে দিয়ে গেল চিবুক।

খান সাহেব, কান্না জড়ানো কণ্ঠেই বলে দিলেন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা ওয়ানডে ম্যাচটাই ছিল তাঁর শেষ। কোলাহল নিমিষেই নিশ্চুপ। গোটা হলরুম জুড়েই নিস্তব্ধতা। শুধু ক্যামেরায় স্থিরচিত্র বন্দী হওয়ার আওয়াজ। বেদনাতুর মিনিট ১৫, দেড় দশক মনে হতে লাগল। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারটার শেষ পাতায় একরাশ দীর্ঘশ্বাস, আর অনুজদের জন্য একটু স্বস্তির আহবান।

ভরা মজলিস থেকে উঠে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন বিষাদ। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একা হাতে বাংলাদেশের উদ্বোধনটা আগলে রেখেছিলেন তামিম। বিদায় বেলায় সবার সামনেই সেই লর্ডসের উদযাপন, পোর্ট অব স্পেনে খেলা বিধ্বংসী ইনিংস কিংবা এশিয়া কাপে একহাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে খেলতে নামা, এসবই ভেসে উঠছিল। এরপরই কেমন আবছা এক ধুম্রজালের মধ্যে বিলীন হয়ে গেলেন তামিম ইকবাল খান। রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়’ লাইনগুলো যেন মৃদু সরে বেজে চলছিল ছোট্ট সেই হলটিতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...