আক্রমণের চেয়ে বড় কোনো স্টেটমেন্ট নেই

তাঁর পরিচয় বলার সাধ্য আমার বা আমাদের নেই। কি বলবো তাঁকে নিয়ে? তিনি একটা বিস্ময়, তিনি একটা ধাঁধা। তামিম মানেই একটা স্টেটমেন্ট, যেখানে বলা থাকে আক্রমণের চেয়ে বড় কোনো স্টেটমেন্ট নেই। তিনি ফিটনেসের ঘাটতি আড়াল করে খেলতে চান, আবার কখনও সবাইকে চমকে দিয়ে নির্বাসনে চলে যান। তিনি তামিম ইকবাল। মানুষ হিসেবে তিনি কলিজাওয়ালা খান, খোদ মাশরাফি বিন মুর্তজাই বলে গেছেন। কিন্তু, তাঁর মনের ভেতরটা তো পুরোপুরিই ধাঁধা।

তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন, জহির খানের মত বোলারদের বিপক্ষে কিভাবে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে ছক্কা হাঁকাতে হয়। কিভাবে স্লেজিংয়ের জবাবে ছক্কা হাঁকাতে হয় – তাঁর কাছ থেকেই তো শেখা। তরুণ ক্রিকেটারের ওপর আসা আক্রমণের জবাব কিভাবে দিতে হয় অফ দ্য ফিল্ড- তামিম ইকবালই প্রথম দেখিয়ে দিয়েছেন।

তিনিই প্রথম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন, লর্ডসের ওই অনার্স বোর্ডে সেঞ্চুরি করে নাম লেখানো যায়, হওয়া যায় উইজডেনের বর্ষসেরা। ইংলিশ কন্ডিশনে পরপর দুই টেস্টে পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষের ভিত নাড়িয়ে সেঞ্চুরি করা যায়। তিনি বলেছিলেন, এমন বিশ্বমানের ব্যাটার বাংলাদেশেরও আছে।

ম্যাগী নুডলস রান্নার সাথে তুলনা হত তাঁর। কি অশ্লীল একটা ট্রল। তিনি শিখিয়েছিলেন, সমালোচনা যতই হোক, ভড়কে গেলে চলবে না। তিনি ফিরেছেন, ফিরে এসেছেন বার বার। সমালোচনার জবাবে তিনি টানা চার ম্যাচে চার হাফ-সেঞ্চুরি করে নিজের মান রেখেছেন, মান রেখেছেন দেশের। বাংলাদেশ প্রথমবার এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলেছেন।

তামিমই প্রথম শিখিয়েছিলেন, একটা প্রান্ত আগলে রাখলে সেঞ্চুরি আসবেই। তিনিই বলেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো ওপেনারের নামও বিশ্বসেরাদের পাশে লেখা যায়। তিনিই বলেছিলেন, ব্যাটিং গড় দিয়ে আকাশ ছোঁয়া যায়। তিনি দেখিয়েছেন চাইলেই ওয়ানডেতে আট হাজার বা নয় হাজার রান করা যায়।

সাকিব আল হাসানের সাথে তাঁর অজানা-অলিখিত একটা দ্বৈরথ। নিন্দুকেরা বলেন, তাঁদের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও নেই। তারা আর বন্ধু নন, স্রেফ সহকর্মী। তবুও, মাঠের বাইরের সম্পর্কটা তিনি মাঠে আসতে দেননি। মিডিয়া না বলে দিলে হয়তো কেউ জানতেও পারতেন না যে, কি ভয়ানক একটা বিরোধ সামলেই মাঠে পাশাপাশি দু’জন লড়াই করেন বীরের মত। সাকিব সেই সময়ে প্রতিপক্ষের চোখ রাঙিয়েছেন, যখন তাঁর পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত। আর তামিম? তিনি পায়ের নিচের মাটি শক্তই করেছেন ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে।

তিনি তামিম ইকবাল খান। তাঁর মগজটা সত্যিই একটা ধাঁধা। তিনি আবারও শিখিয়ে গেলেন চাইলে বিশ্বকাপ শুরুর নব্বই দিন আগেও বিদায় বলে ফেলা যায়। অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ খেলার অনন্য সুযোগ স্রেফ বৃহত্তর স্বার্থে ছেড়ে দেওয়া যায়। তামিম নিজেও জানেন, তিনি ছেড়ে দিলে জায়গাটা যোগ্য কারও হাতেই যাবে।

তামিম ধাঁধার উত্তরটা হয়তো জানা হবে না কোনো দিন। তবে, তামিমের এই সাহসী সিদ্ধান্তটা লেখা রয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। আর সেই লেখা বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে – তামিম হতে কলিজা লাগে।

তিনি বিদায় বলে ফেলেছেন, শেষবারের মত আর কখনোই দেখা যাবে না তাকে বাংলাদেশের জার্সিতে। কি হৃদয় বিদারক একটা দৃশ্য। আমরা অনেকেই তামিমের এই চলে যাওয়াটা প্রত্যাশা করতাম। কিন্তু, তামিমের মত কলিজা তো আমাদের নেই। তাই, এই দৃশ্য দেখাটা ঠিক সুখকর হল না। সবাই চাইলেও তামিম হতে পারে না। বলেছেন, তাঁর ছেলেটা বড় হলে বুঝবে বাবাকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট কি আদৌ বুঝবে? কি জানি! সব বুঝলে নষ্ট জীবন। কিছু ধাঁধার উত্তর না পাওয়াই শ্রেয়

একদিন আমাদের নাম, আমাদের কথা – সব হারিয়ে যাবে। কিন্তু, তামিম ইকবাল খানের নামের পাশে ১৫,২০৫ রান আর ২৫ টা সেঞ্চুরি লিখা থাকবে। আবারও বলি, সবাই চাইলেই তামিম হতে পারে না।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link