ভারতের অপ্রত্যাশিত পঞ্চ-পতন

দুই, চার, দুই যথাক্রমে ভারত ক্রিকেট দলের বর্তমান টেস্ট ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির বিশ্ব র‍্যাংকিং। দুইটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ শিরোপা, একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি রয়েছে টিম ইন্ডিয়ার ট্রফি ক্যাবিনেটে। অন্তত এই র‍্যাংকিং এবং শিরোপার সংখ্যা ক্রিকেট অঙ্গনে ভারতের আধিপত্যের প্রমাণ দেয়। মাঠের ক্রিকেটে ভারতকে হারানো বড্ড কঠিন। তাঁদের প্রতিটা খেলোয়াড়দের নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা ব্যতীত ভারতকে ক্রিকেটের ময়দানে কুপকাত করার উপায় মাত্র একটি ভাগ্য। তবে ভাগ্যও অধিকাংশ সময়ে ভারতের সুপ্রসন্ন থাকে।

কিন্তু সম্প্রতি শেষ হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আশানুরুপ ফল না পাওয়া ভারত দলের এমন হতাশাব্যঞ্জক টুর্নামেন্টের সমাপ্তি ভক্ত-সমর্থকদের মন খারাপের কারণ হয়েছে। তবে এমন ঘটনা এবারই প্রথমবার ঘটেনি। নিকট অতীতে বেশ ক’বার টিম ইন্ডিয়া ধুকেছে আইসিসি আয়োজিত বৈশ্বিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে। সেসব নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন।

  • ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০০৭

ভারতের ব্যাটিং লাইন আপ তখন মারাত্মক শক্ত। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, বীরেন্দ্র শেবাগ আর রাহুল দ্রাবিড় – আর কিছুর দরকার হয় না। তাঁর ওপর আগের বিশ্বকাপের রানার আপ। ভারতের ওপর প্রত্যাশার চাপ যেন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

গ্রুপ পর্বটাও কঠিন কিছু না। শ্রীলঙ্কার সাথে ছিল বাংলাদেশ বারমুডা। অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের দল এই সময়ে এসে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের ভুতুড়ে সিদ্ধান্তে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে নামলো পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। তাতেই কপাল পুড়লো।

‘বি’ গ্রুপে প্রথম ম্যাচেই হার। পরের ম্যাচে বিরাট ব্যবধানে বারমুডাকে হারালেও শেষ রক্ষা হল না। শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আবারও অসহায় আত্মসমপর্ণ। ব্যস, গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দেশে ফিরলো ভারতীয় দল।

  • টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৪ 

বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী সময়ে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের টি-টোয়েন্টি পারফর্মেন্স যথেষ্ট পরিমাণ আশা জাগানিয়া ছিল। ভারতের অধিকাংশ দর্শক-সমর্থক হয়ত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে ভারত আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিততে চলেছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টে বাড়তি সুবিধা হিসেবে ছিলে চেনা কন্ডিশন।

তাছাড়া ব্যাটিং-বোলিং সব ডিপার্টমেন্টে ভারত দল ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁদের ব্যাটিং লাইন আপের মিডেল অর্ডার ছিল তৎকালীন অন্যতম সেরা। তাঁরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। সেমিফাইনলের দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিরুদ্ধে ছয় উইকেটের বড় জয় নিয়ে ফাইনালে ওঠে ভারত।

সবাই যখন আশায় বেঁধেছে বুক নতুন এক শিরোপা জয়ে। ঠিক তখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে অল্প রানেই আটকে যায় ভারত। শেষমেশ লঙ্কান উইকেট রক্ষক কুমার সাঙ্গাকারার অর্ধশতকে শিরোপা নিজেদের করে নেয় শ্রীলঙ্কা। রানার আপ হওয়ার পরও দলটাকে ব্যর্থ বলার কারণ, মহেন্দ্র সিং ধোনির এই দলটি বিশ্বকাপে গিয়েছিল পরিস্কার ব্যবধানে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে থেকে।

  • ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০১৫

বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁদের মাঠে গিয়ে ধরাশায়ী হয়ে আসা ভারত দলের প্রতি ২০১১ এর পর আবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় নিয়ে শঙ্কার জাগে আপামর ক্রিকেট দর্শকদের মাঝে।

তাঁদের বিশ্বকাপ পূর্ববর্তী সিরিজের গ্লানি ভুলে ভারত দল নতুন এক উদ্যমে শুরু করে বিশ্বকাপের যাত্রা। সবার দুশ্চিন্তা দূর করে গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানের মত শক্তিশালী দলকে হারায় এর পাশাপাশি গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচ জিতে পরবর্তী রাউন্ড পদার্পণ করে ভারত দল।

কোয়ার্টার ফাইনালেও নিজেদের স্বভাবসুলভ ক্রিকেট খেলে সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছে যায়। কিন্তু সেমিফাইনালের গণ্ডি আর পার হওয়া হয় না সেবারের মতো। প্রতিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া রীতিমত ছেলেখেলা করে হারিয়ে বাজিয়ে দেয় ভারতের বিদায়ের ঘন্টা। আবার শিরোপা জয়ের আশা নিভে যায়।

  • টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০১৬ 

২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ ছিল ভারত। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের উপর প্রত্যাশার চাপ ছিল বেশি। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগেই ভারতেই অনুষ্ঠিত হওয়া এশিয়া কাপের ফাইনলে বাংলাদেশকে হারিয়ে শিরোপা জেতা ভারত ফেভারিটের তকমা গায়ে জড়িয়েই খেলতে নামে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

তবে প্রথম ম্যাচেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারে তাঁদের আশার প্রদীপের আলো ক্ষীণ হতে থাকে। কিন্তু পরবর্তী দুই ম্যাচে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে হারিয়ে গ্রুপ পর্ব পার করে ভারত। তবে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেবারের জয়টা ছিল কষ্টার্জিত মাত্র এক রানের জয়। গ্রুপ পর্ব পেড়িয়ে সেমিফাইনালে গিয়ে সেবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ধরাশায়ী হয় টিম ইন্ডিয়া। আবার নকআউট পর্ব থেকে বিদায়।

  • চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০১৭

ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে অনুষ্ঠিত হওয়া ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে বৃষ্টি আইনে জয় দিয়ে শুরু করে ভারত। কিন্তু পরবর্তী গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ভারত দলের দূর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যায়। বোলারদের ব্যর্থতায় খুব সহজেই হেরে যায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। কিন্তু শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো ভারত দল পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।

সেমিফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় তুলে নিতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি ভারত দলকে। প্রায় দশ ওভার হাতে রেখেই জয় সুনিশ্চিত করে ফাইনালের টিকিট কাঁটে ভারত জাতীয় ক্রিকেট দল। ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দী পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় ভারত। সাম্প্রতিক রেকর্ড অনুযায়ী বৈশ্বিক কোন টুর্নামেন্টে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দে ভারতের পাল্লা ভারী থাকায় স্বভাবিকভাবেই সকলের প্রত্যাশা ছিল শিরোপা জিতবে ভারত। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতের ব্যাটিং ধসে পড়লে ১৮০ রানে হারে আরো একটি শিরোপা জয়ে আশা ভঙ্গ হয় ভারতীয়দের।

ভারত নিঃসন্দেহে বিশ্ব ক্রিকেটের একটি প্রতাপশালী দল। তবে ইতিহাসে এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে যে ভারত আইসিসি আয়োজিত বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের নক-আউট কিংবা খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হেরেছে। কিছুকিছুবার তো খুবই লজ্জাজনকভাবে। ভারতের এই নক-আউট পর্যায়ে এসে কলাপ্স করার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কেবল তবেই ভারত হতে পারবে বিশ্বের সেরা ক্রিকেট দল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link