২০ মার্চ, ১৯৯২। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের ২৪ ঘন্টা আগে তখন শারীরিক অসুস্থ পাকিস্তানি তরুন তারকা ইনজামাম উল হক। পরের দিন শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল। ইনজামাম নিজেও বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তিনি সেমিফাইনালে খেলছেন না তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু বেঁকে বসলেন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান। ইমরানের সোজা-সাপটা কথা ইনজামামকে পরের ম্যাচে খেলতে হবে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো!
ইমরান খানের কথাতেই অনেক জোরপূর্বক সেমিফাইনালে খেলার জন্য তৈরি হলেন ইনজামাম। গায়ে তেমন শক্তিও পাচ্ছিলেন না, শরীরে দূর্বলতা! তবু অধিনায়কের আস্থা ইনজামামের উপর। এমনকি ওই বিশ্বকাপে চরম বাজে সময় পার করছিলেন ইনজামাম। বড় কোনো ইনিংসও খেলতে পারেননি! তবুও ইমরান খান যেন ইনজিকে নিয়ে ছিলেন বেশ আশাবাদী।
২১ মার্চ, ১৯৯২। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নামে নিউজিল্যান্ড। একাদশে থাকলেও শারীরিক দূর্বলতার কারণে শুরুর দিকে কিছু সময় মাঠে ছিলেন না ইনজামাম। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৩৯ রানেই আউট দুই ওপেনার। এরপর একপ্রান্তে মার্টিন ক্রো’র দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বড় সংগ্রহের দিকে এগোতে থাকে ব্ল্যাকক্যাপসরা।
কেন রাদারফোর্ড ও মার্টিনের ১০৭ রানের জুটিতে ম্যাচে তখন ব্যাকফুটে পাকিস্তান। রাদারফোর্ড ৫০ রানে আউট হলেও সেঞ্চুরির দিকে এগোতে থাকে মার্টিন ক্রো। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৯ রান দূরে থাকতে ব্যক্তিগত ৯১ রানে ফিরেন মার্টিন! ৩ ছক্কা ও ৭ চারে খেলেন দুর্দান্ত এক ইনিংস।
শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২৬২ রান সংগ্রহ করে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। পাকিস্তানের পক্ষে ওয়াসিম আকরাম ও মুশতাক আহমেদ শিকার করেন দু’টি করে উইকেট।
২৬২ রান তখনকার সময় বিবেচনায় অনেক! বর্তমান ফ্ল্যাট উইকেট বিবেচনায় নিলে ২৬২ এখনকার সময়ে ৩২০-৩৫০ রানের সমান! পাকিস্তানের সামনে তাই কঠিন এক লক্ষ্যমাত্রা। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুতে দলীয় ৩০ রানে আউট আমির সোহেল।
এরপর দ্বিতীয় উইকেটে ইমরান খানের সাথে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দেন রমিজ রাজা। দু’জনে মিলে গড়েন ৫৪ রানের জুটি। দু’জনের ব্যাটে বেশ ভালো এগোচ্ছিল পাকিস্তান। তবে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রানটা ঠিকঠাক আসছিল না। এরপর দলীয় ৮৪ রানে ব্যক্তিগত ৪৪ রানে ফেরেন রমিজ।
ইমরানের খানের সঙ্গী তখন জাভেদ মিঁয়াদাদ। তৃতীয় উইকেটে দু’জনে গড়লেন ৫০ রানের আরও একটি অসাধারণ জুটি। এরপর দ্রুত ইমরান খান ও সালিম মালিক বিদায় নিলে ১৪০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন বিপাকে পাকিস্তান! ক্রিজে তখন তরুন ইনজামাম ও জাভেদ। ৩৭ ওভার শেষে দলের রান ৪ উইকেটে ১৫৪! শেষ ৭৮ বলে তখনো দরকার ১০৯ রানের, হাতে ৬ উইকেট।
এরপর শুরু ইনজি ঝড়! টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ক্রিস হ্যারিসকে চার-ছক্কা হাঁকিয়ে দিলেন ঝড়ের আভাস। চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে মাত্র ৩১ বলে ফিফটি তুলে নেন ইনজামাম। প্রথম ১০ বলে ১০ রান করা ইনজি বাকি ২১ বলে করেন ৪০ রান! ৪৪ ওভারে তখন দলের রান ৪ উইকেটে ২২৪! ইনজি ঝড়ে ম্যাচে তখন পাকিস্তানের আধিপত্য। শেষ ৬ ওভারে দরকার ছিল মাত্র ৩৯ রানের, হাতে তখনো ৬ উইকেট।
এরপরই ৪৫ তম ওভারে একপ্রান্ত আগলে রেখে অসাধারণ এক ফিফটি তুলে নেন জাভেদ মিঁয়াদাদ। ওই ওভারেই শেন ওয়াটসনের বলে দুর্ভাগ্যবশত রান আউটের শিকার হয়ে ফেরেন ইনজি। ৩৭ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৬৩ রানের ঝড়ো ইনিংস শেষে আউট হন ইনজামাম। এরপর ৪৭ তম ওভারে ওয়াসিম আকরাম ৯ রানে ফিরলে শেষ ৩ ওভারে তখন দরকার ১৯ রানের, হাতে তখন ৪ উইকেট। সেখান থেকে শেষ ২ ওভারে দরকার ১২ রান।
মঈন খান ও জাভেদের ব্যাটে তখন সহজ জয়ের স্বপ্নে বিভোর পাকিস্তান। ৪৯ তম ওভারের প্রথম ৪ বলে হ্যারিস দেন মোটে ৩ রান! শেষ ৮ বলে দরকার ৯ রানের। কিন্তু এরপরই পর পর দুই বলে মঈন খানের ছক্কা ও চারে এক ওভার বাকি থাকতে ৪ উইকেটের দুর্দান্ত এক জয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় পাকিস্তান!
সেবার গ্রুপ পর্বে আট ম্যাচের সাতটিতেই টানা জয় পায় নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে যেই এক ম্যাচে হারে সেটিও ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষেই! ওই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড সংগ্রহ করে মোটে ১৬৬ রান! জবাবে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় পাকিস্তান! টানা সাত জয়ে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখা নিউজিল্যান্ড গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ ও সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়।
গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচে মাত্র ৫ রানে আউট হন ইনজামাম। ওই ম্যাচের পর গোসল করতে যাওয়ার পর সেখানে একজন সতীর্থ ক্রিকেটার তাঁকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজও করেন! এতে বেশ কষ্ট পান ইনজি। এমন কি সেদিন কান্নাও করেন এই তরুণ তারকা। তবে পরের ম্যাচেই সেমিফাইনালে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ৩৭ বলে ৬৩ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তোলার নায়ক বনে যান ইনজি!