রোজ বোল টেস্ট, পঞ্চম দিন। পুরো দিনটা বৃষ্টিতে ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটা ড্র দিয়ে শেষ হচ্ছে সেটা নিশ্চিত। তবে, ড্রেসিং রুম থেকে ২২ গজে যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন একজন। মাত্র একটা উইকেটের অপেক্ষা। সিরিজের শেষ টেস্ট হওয়ায় সমর্থকরাও খুব করে চাইছিলেন কিছু সময়ের জন্য খেলাটা হোক। একটা উইকেট, একটা অনন্য মাইলফলক। ঈশ্বরের কৃপায় শেষ অবধি রোজ বোলের কালো মেঘ ভেদ করে দেখা দেয় সূর্য। শেষ বিকেলে মাঠে নামলো দুই দল।
ঈশ্বরের কৃপা, নিজের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে আজহার আলীর উইকেট – প্রথম পেসার হিসেবে টেস্ট ইতিহাসে ছয়শো উইকেটের মাইলফলকে জেমস অ্যান্ডারসন। ইতিহাসে মাত্র চতুর্থ বোলার হিসেবে সাদা পোশাকে ছয়শো উইকেটের অনন্য কীর্তি গড়েন এই ইংলিশ পেসার। এই মাইলফলকটা আরও আগেই স্পর্শ করতে পারতেন। ক্যাচ মিসের মহড়ায় অপেক্ষার প্রহরটা শুধুই বেড়ে চলেছিল।
দুই বছর না ঘুরতে এবার আরও এক মাইলফলকের হাতছানি। ইতিমধ্যে অনিল কুম্বলেকে টপকে টেস্টে তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এবার হাতছানি তৃতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ৬৫০ উইকেট শিকারের।
মাত্র দিন পনেরো বাদে চল্লিশ বছরে তিনি পা দিবেন। তাঁর পরে ক্যারিয়ার শুরু করা প্রায় সবাই ব্যাট-প্যাড তুলে রেখে অন্য পেশায় জড়িয়েছেন কিংবা ক্রিকেটের সাথে অন্য কোনো ভূমিকায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ বা আবার পরিবারকে সময় দিচ্ছেন, আর টিভির পর্দায় খেলাটা উপভোগ করছেন। এর মধ্যে বহু ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসছে, গেছে। কিন্তু, ২২ গজে এখনো ছুঁটছেন অ্যান্ডারসন।
ইনিংসের পঞ্চম বল। রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে গুড লেন্থে, অফ স্টাম্পের খানিকটা বাইরে বল করলেন। আউটস্যুইং হয়ে বের হয়ে যাবে, এই ভাবনায় ব্যাট উঁচিয়ে বলটা ছেড়ে দিলেন টম ল্যাথাম। ভাবনার বিপরীতে যেয়ে বল আঘাত হানলো অফ অ্যান্ড মিডল স্টাম্পের মাঝে। দুর্দান্ত এক ইনস্যুইংয়ে ল্যাথামকে বোল্ড করলেন অ্যান্ডারসন।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে আগে অ্যান্ডারসনের উইকেট সংখ্যা ছিল ৬৪৬। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট শিকারের পর অনন্য রেকর্ডে নাম লেখাতে প্রয়োজন ছিল মাত্র এক উইকেটের। ইনিংসের প্রথম ওভারেই ল্যাথামকে অসাধারণ এক ডেলিভারিতে বোকা বানিয়ে ছয়শো পঞ্চাশ উইকেটের মাইলফলকে পা দেন জিমি।
অথচ এক সিরিজ আগেও তিনি জানতেন না আর কখনো ২২ গজে ফিরতে পারবেন কি-না। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের আগে ১৭ টেস্টে ইংলিশরা জয়ের দেখা পেয়েছিল মোটে একটিতে। জো রুট ছাড়া ধারাবাহিক পারফরমার ছিলেন না কেউই। বয়সের দোহাই দিয়ে দল থেকে কাটা পড়লো সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই পেসার অ্যান্ডারসন ও ব্রডের নাম।
সমর্থকদের প্রশ্ন, ‘ব্রড-অ্যান্ডারসন জুটি কি তাহলে নিজেদের ক্যারিয়ারের শেষটা দেখে ফেলেছে?’ বয়সের হিসেবে অনেকেই অ্যান্ডারসনের ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। বেন স্টোকস অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েই জানালেন, সবার প্রথমে ব্রড-অ্যান্ডারসনকে দলে ফেরাবেন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো, আরেকটি সুযোগ; আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করলেন।
টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে ৮০০ উইকেট নিয়ে লঙ্কান কিংবদন্তি তারকা মুত্তিয়া মুরালিধরন আছেন শীর্ষে। ৭০৮ উইকেট নিয়ে পরের অবস্থান অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি সদ্য প্রয়াত শেন ওয়ার্ন। ৬৫০* উইকেট নিয়ে তিনে আছেন অ্যান্ডারসন। শীর্ষে হয়ত যেতে পারবেন না, তবে এভাবে ছুঁটতে থাকলে হয়ত ওয়ার্নকেও ছুঁয়ে ফেলবেন তিনি।
চুলে পাঁকন ধরেছে, বয়সও বাড়ছে ঠিক; কিন্তু চেহারায় কিংবা শরীরী ভাষায় ক্লান্তির ছাপ মোটেও নেই। এখনও ছুঁটছেন, সেই আগের মত স্যুইং, পেস – প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের মাত দিচ্ছেন; তিনি কোথায় থামবেন সেটা হয়ত নিজেও জানেন না। সেই ১৯ বছর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে লর্ডসে সাদা পোশাকে দৌড় শুরু; এখনও তিনি ছুঁটছেন এখনও অবিরাম গতিতে। ধারাবাহিকতা আর ফর্ম ধরে রেখে এভাবেই তিনি ছুঁটতে থাকুন অবিরাম গতিতে – সমর্থকদের চাওয়াটা এটাই।