সেবারের গ্রীষ্মটা ছিল ডাচদের। লম্বা চুলের এক ডাচম্যান তাঁর ফুটবল জাদুতে মুগ্ধ করেছিলেন গোটা বিশ্বকে, বদলে দিয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবলের গতিপথ। সেটা ছিল ইয়োহান ক্রুইফের গ্রীষ্মকাল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও রাজ দন্ডটা ছিল তাঁর হাতেই।
১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে তিনি রীতিমত ফুটবল পায়ে জাদু দেখাচ্ছিলেন। বলে তাঁর প্রতিটি ছোঁয়া যেন ছিল শিল্পীর তুলির আঁচড়। শুধু তাই নয়, ডর্টমুন্ডের ওয়েস্টফ্যালেনস্ট্যাডিয়নে সুইডেনের জান ওলসেনকে বোকা বানিয়ে যে টার্ন নিয়েছিলেন তা ফুটবল ইতিহাসের লোককাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
ক্রুইফ তাঁর আত্নজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘ওই টার্নটা আমি সেবারই প্রথম করিনি। এর আগে প্র্যাকটিসে বেশ কয়েকবারই করেছি। মুহুর্তের মাঝে আইডিয়াটি আমার মাথায় এসেছিল কারণ ঔ বিশেষ মূহুর্তে সেটাই সবচেয়ে ভাল সমাধান ছিল।’ তাঁর এই আবিষ্কার, বুদ্ধিমত্তা, অসামান্য সব মুহুর্তের জন্ম দেয়া – সবই ফুটবলকে প্রভাবিত করেছে ভীষণভাবে।
টোটাল ফুটবল আবর্তিত হচ্ছিল ক্রুইফকে ঘিরেই। ১১ জন ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে মাঠে নামলেও খেলা শুরুর পর আর নির্দিষ্ট পজিশনে আটকে থাকতেন না, বরং খেলাটাকে ছড়িয়ে দিতেন মাঠজুড়ে।
কমলা জার্সিতে ডাচ ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন ক্রুইফ। তিনি যেন ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে। বিখ্যাত কোচ আর্সেন ওয়েংগার একবার বলেছিলেন, ‘আজকের দিনে প্রেসিং, ট্রান্সজিশন, দ্রুত বলের দখল নিয়ে কথা হয়, অথচ ১৯৭৪ সালেই সেটা করে দেখিয়েছে ডাচরা। ট্যাকটিক্যালি তাঁরা ছিল বাকিদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। তাঁদের ছিল নিজেদের উপর অগাধ বিশ্বাস এবং তাঁরা নিজেদের খেলার ধরণের সাথে আপোষ করতো না।’
টোটাল ফুটবলের শুরুটা হয়েছিল আয়াক্সে। ক্লাব থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দূরত্বেই আমস্টারডামে ক্রুইফের জন্ম। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র দশ বছর বয়সেই ক্লাবে যোগদান, এরপর সেখানেই বৃত্তি নিয়ে ফুটবল জীবন শুরু। রাইনাস মিশেলসের অধীনে আয়াক্স দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হন যারা কিনা শাসন করেছে ইউরোপিয়ান ফুটবল।
মিশেলস নিজে হাংগেরির বিখ্যাত ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের সেই দল থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আয়াক্স পেয়েছিল তাঁদের সাফল্য। ১৯৭১ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি জেতার পরের বছরেই পাড়ি জমান স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনায়।
সাবেক আয়াক্স অ্যামস্টারডাম এবং ডাচ ফুটবলার রুড ক্রল বলেছিলেন, ‘মিশেলস আমাদের কম দৌঁড় করাতেন এবং একে অন্যের পজিশন নিতে বলতেন, যেটা ছিল যুগান্তকারী এক আইডিয়া। সেবারই প্রথমবারের মত ভিন্ন এক ধাঁচের ফুটবল দেখেছিল বিশ্ববাসী। টোটাল ফুটবল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল।’
১৯৭৩ সালে দ্বিতীয়বারের মত ব্যালন ডি’অর জেতার পর নেদারল্যান্ডসের জাতীয় বীরে পরিণত হন ক্রুইফ। নেদারল্যান্ডসের তরুণরা তখন ক্রুইফ হতে চাইতেন, সন্তান সম্ভবা মায়ের ঘরের দেয়ালে শোভা পেত তাঁর ছবি। ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিপক্ষের রক্ষণকে নাচিয়ে ছাড়তেন। রেকর্ড ট্রান্সফার ফি-তে বার্সেলোনায় যোগ দেন ক্রুইফ এবং ১৪ বছর পর লিগ শিরোপা জিততে সহায়তা করেন দলটিকে।
তবে জাতীয় দলে বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাঁকে। সতীর্থরা প্রায়ই অভিযোগ জানাতেন ক্রুইফ স্পেন থেকে দেরিতে দলে যোগ দিতেন। তাছাড়া বিশ্ব ফুটবলে ডাচদের অবস্থানও বেশি ভাল ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তাঁরা কখনও বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে পারেনি এবং ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবার সুযোগ পায়নি।
এমনকি ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপেও তাঁরা সুযোগ পায় বিতর্কিতভাবেই।বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৮৯ মিনিটে বিতর্কিত এক গোলে জয় পায় ডাচরা। যদিও বেলজিয়ান ডিফেন্ডারদের দাবি ছিল অফ সাইডে ছিলেন গোলদাতা জ্যান ভার্হেন। তবে চেক কোচ ফ্রান্টিসেকের জায়গায় রাইনাস মিশেলস কোচ হয়ে আসলে বদলে যায় ডাচদের চেহারা।
জাতীয় দলের বেশিরভাগ ফুটবলার ছিলেন আয়াক্স এবং ফ্রেইনুর্দের। আয়াক্সের ফুটবলাররা আগে থেকেই মিশেলসের খেলার ধরণ সম্পর্কে জানতেন, ফলে জাতীয় দলে মানিয়ে নিতে তাঁদের তেমন একটা সমস্যা হয়নি। যদিও শুরুর দিকে প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানির কাছে হেরে যায় তাঁরা। কিন্তু বিশ্বকাপের এক সপ্তাহ আগে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৪-১ গোলের জয় আত্নবিশ্বাসী করে তোলে ডাচদের।
হ্যানোভারে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে নেদারল্যান্ডস। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররা ক্রুইফকে টার্গেট করে মারমুখী ফুটবল খেললেও দারুণ দক্ষতায় সেসব কাটিয়ে যান তিনি। কড়া মার্কিংয়ে থাকার দরুণ তিনি নিজে গোল না করলেও রেপের জোড়া গোলে জয় পায় ডাচরা। চারদিন বাদে দ্বিতীয় ম্যাচে সুইডেনের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করেন ক্রুইফরা।
সেই ম্যাচে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের অবিস্মরণীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে স্টেডিয়ামে। শেষ ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে সহজেই ৪-১ গোলের জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে ওঠেন ক্রুইফরা।
ম্যাচের শুরুতেই বক্সের মাঝে ক্রুইফকে ফাউল করলে পেনাল্টি পায় ডাচরা, সেখান থেকে দলকে এগিয়ে দেন নেসকেন্স। এছাড়া পরে অসাধারণ এক ফ্রি কিকে নিজেও স্কোরশিটে নাম তোলেন ক্রুইফ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি।
টুর্নামেন্টের ফরম্যাট অনুযায়ী পরের রাউন্ডেও খেলতে হয়েছিল গ্রুপপর্ব। সেই পর্বে প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয় ডাচরা। সেই ম্যাচে তাঁদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি আলবিসেলেস্তারা।
বৃষ্টি মুখর সেই ম্যাচে ক্রুইফের জোড়া গোলে ৪-০ ব্যবধানে বিশাল জয় পায় নেদারল্যান্ডস। সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে এতটাই দুর্দান্ত খেলেছিল ডাচরা, তাঁদের গোলরক্ষক জোংকব্লয়েড বল স্পর্শ করেছেন মাত্র একবার। পরের ম্যাচেও অব্যাহত থাকে ডাচদের জয়ের ধারা, পূর্ব জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমিতে পৌঁছে যায় তাঁরা।
শেষ চারে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডস। সেবারের ব্রাজিল ছিল পেলেবিহীন ব্রাজিল, ১৯৭১ সালেই জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নেন ফুটবল জাদুকর। তারপরও জেয়ারজিনহো এবং রিভেলিনোদের নিয়ে গড়া ব্রাজিলের আক্রমণভাগ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী।
প্রথমার্ধে দুই দল সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করলেও দ্বিতীয়ার্ধে আর পেরে ওঠেনি সেলেসাওরা। নেসকেন্স এবং ক্রুইফের দুই গোলে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে নেদারল্যান্ডস।
ফাইনালে মুখোমুখি হয় টুর্নামেন্টের সেরা দুই দল পশ্চিম জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডস। ডাচরা ফাইনালের আগে এতটাই আত্নবিশ্বাসী ছিল যে, তাঁদের কোচ রাইনাস মিশেলস ফাইনালের আগে স্পেনে উড়ে গিয়েছিলেন বার্সেলোনার স্প্যানিশ কাপের ফাইনাল দেখতে। তবে মূল অঘটনটা ঘটে জার্মান দৈনিক বিল্ডের প্রতিবেদনে।
অনেকদিন ধরে পরিবার ছাড়া থাকায় ডাচ ফুটবলাররা খানিকটা অবসাদে ভুগছিলেন, তাই ফাইনালের আগে চাঙা হবার জন্য পার্টির আয়োজন করেছিলেন। সেই পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন বিল্ডের এক সাংবাদিকও, তাঁরা লিখে সারারাত মদ আর নারীসংগে মেতে ছিলেন ক্রুইফ। ফলশ্রুতিতে দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হয় তাঁর, ফাইনালের আগের প্রায় পুরোটা সময় তাঁকে হোটেলে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে দেখা গিয়েছিল। অবশেষে মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ফাইনালে মুখোমুখি হয় দুই দল।
ম্যাচের প্রথম দুই মিনিটেই ক্রুইফ ম্যাজিকের সামনে হতবিহবল জার্মান ডিফেন্স। বক্সের বাইরে তাঁর ড্রিবলিংয়ে চিড় ধরে তাঁদের ডিফেন্সে, তাঁকে থামাতে উলি হোয়েন্স ফাউল করে বসেন বক্সের মধ্যে।
স্পটকিক থেকে বল জালে জড়াতে কোনো সমস্যাই হয়নি নেসকেন্সের। সবাই ভেবেছিল আরও একবার বড় ব্যবধানে হারবে জার্মানি, কমলা উৎসবে মাতবে বিশ্ব। তবে খেলার বিপরীত ধারায় ২৫ মিনিটে পেনাল্টি পেয়ে যায় জার্মানিও, দলকে সমতায় ফেরান পল ব্রেইটনার।
ফাইনালে ক্রুইফ খেলছিলেন ফলস নাইন রোলে। দলের প্রতিটি আক্রমণের সূচনা হচ্ছিল তাঁর পা থেকে, অনবদ্য ড্রিবলিং আর পাসিং দক্ষতায় দারুণ সব সুযোগ সৃষ্টি করছিলেন। কিন্তু জমাট রক্ষণের সুবাদে বারবার বেঁচে যাচ্ছিল জার্মানরা। কিন্তু প্রথমার্ধের শেষের দিকে জার্মান অধিনায়ক জার্ড মুলার গোল করে এগিয়ে দেন স্বাগতিকদের। ব্যাস, ওখানেই শেষ। দ্বিতীয়ার্ধে হাজার চেষ্টা করেও ম্যাচে সমতা ফেরাতে পারেননি ক্রুইফরা।
অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে মাথানিচু করে বিদায় নেন ক্রুইফরা। অন্যদিকে ম্যাজিকাল ম্যাগিয়ার্সের পর আরও এক পরাশক্তিকে হারিয়ে বিশ্বজয়ের উল্লাসে মাতে জার্মানরা। তবে ফাইনাল হারলেও ফুটবলের গতিপথটাই পাল্টে দিয়েছে ক্রুইফদের টোটাল ফুটবল।