কানপুরের গ্রিনপার্কে কিউই প্রতিরোধ দেখে ফিরে যাচ্ছিলাম বছর সতেরো আগের এই গ্রিনপার্কেরই একটা টেস্টে। সেবার ভারতের বিরুদ্ধে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, গ্রায়েম স্মিথ দলবল নিয়ে এসেছিলেন ভারতে টেস্ট খেলতে। এবারে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ত্রিফলা স্পিন আক্রমণের মত সেবারও ছিল তিন স্পিনার আর জহির খান ও সৌরভ গাঙ্গুলিকে নিয়ে দেড়খানা পেসার।
সেবারের তিন স্পিনারের নাম ছিল কুম্বলে, হরভজন সিং আর মুরালি কার্তিক, তো সেই তিন স্পিনারের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ৪৫৪টা বলের মোকাবেলা করে ১৬৩ রানের এক ম্যারাথন ইনিংস খেলেছিলেন সেবারের এক প্রোটিয়া ওপেনার। নামে কোনদিনই বিশাল কিছু ছিলেন না কিন্তু কাজে একেবারে ‘জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ’ অবধি সবকিছুই পারতেন।
নাম তাঁর অ্যান্ড্রু হল, সেই কানপুর টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রায় ২০০র কাছাকাছি রান আবার শচীন, বীরুর মত দু’খানা সোনার মতো উইকেট ও ছিল হলের দখলে। সেবারের ভারত সফরে স্মিথের সঙ্গী হিসেবে হল ওপেন করলেও দক্ষিণ আফ্রিকা দলের নিয়মিত ওপেনার কস্মিনকালেও ছিলেন না, তাহলে ঠিক কী ছিলেন হল?
ব্যাটিং অর্ডারে টেস্ট বা ওয়ানডে যে কোনো ফরম্যাটেই ১ থেকে ১০ সমস্ত পজিশনে ব্যাট করার ক্ষমতা রাখতেন, ক্যাপ্টেন যদি বোলিং ওপেন করতে ডাকেন কিংবা ডেথ ওভারে বিপক্ষের রান আটকাতে ডাকেন তাতেও তিনি হাত তুলে আছেন, আবার বাউচার উইকেটের পেছনে অনুপস্থিত থাকলেও কোনো অসুবিধে নেই, যদি হল টিমে থাকেন।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে কিপিং করেও দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাও তিনি পারেন। এমন একজন ক্রিকেটারকে এ যুগের দক্ষিণ আফ্রিকা দল পেলে অবশ্যই লুফে নিতো, কিন্তু সেকালের ক্যালিস, ক্লুজনার, পোলক, জাস্টিন কেম্পদের মত অলরাউন্ডার দলে থাকায় নিয়মিত প্রথম একাদশে থাকতে পারতেন না বহুমুখী ক্ষমতা নিয়েও, তবে স্কোয়াডে থাকতেন নিয়মিত।
কানপুরের সেই টেস্টে হলের অমন ইনিংস অনেকের চোখ কপালে তুলে দিলেও কেপটাউনে অভিষেক টেস্টেই দুর্ধর্ষ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৭০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, কিংবা বছর খানেক বাদে হেডিংলি টেস্টে হগার্ড – ফ্লিনটফ দের বিরুদ্ধে এসেছিলো অপরাজিত ৯৯ রানের ইনিংস ও। তবে ভারতের বিরুদ্ধে ওই অসাধারণ ইনিংস খেলার পরে টেস্টে অমন কিছু আর কোনোদিনই করে দেখাতে পারেননি, মোটামুটি নিয়মিত ওয়ানডে খেলতেন, মুরালির ছোবল সামলে গলে ৮১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন সেবার।
তবে মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে কার্যকরী ছিলেন হল, ২০০৭ বিশ্বকাপের জন্য নিজের সেরাটা তুলে রেখেছিলেন, সেবার নিয়েছিলেন ১৪টা উইকেট। যদিও মাসকয়েক পরেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে সুযোগ না পেয়ে হতাশায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরই নিয়ে নেন, তবে কাউন্টি ক্রিকেটে বহুবছর ধরেই হল ছিলেন নিয়মিত মুখ।
মুরালি, কুম্বলে, হরভজন, ওয়ার্নদের স্পিন ছোবল যেমন দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন হল, তেমনই মৃত্যুমুখ থেকেও ফিরে এসেছেন বার দুয়েক। একবার এটিএমে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন, দুষ্কৃতিরা ছয়টা গুলি চালায়, একটা বুলেট তাঁর হাতে এসে সজোরে লাগে, ঘটনার আকস্মিকতায় ভেঙে পড়েননি, উল্টে আরো শক্ত করে তুলেছিলেন মনকে। আরেকবার তাঁর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা, সেবারও ঠান্ডা মাথায় মনকে শক্ত করে রেখেছিলেন।
এই দুই ঘটনাই তাঁর ক্রিকেট জীবনে বিরাট মানসিক শক্তি হয়ে আসে, যার ফলে যেকোনো পরিস্থিতেই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ার ক্ষমতাও বোধহয় এভাবেই পেয়ে যেতেন হল। ভারতের মাটিতে অনেক বিদেশি ওপেনার বা মিডল অর্ডার ব্যাটার গত ১৫ – ২০ বছরে এসে স্পিনের সাঁড়াশি আক্রমণ সামলে বড় রান করে গেছেন, কিন্তু কানপুর টেস্ট আর কোনো বিদেশি ব্যাটারের প্রতিরোধ বললে ওই ‘সবজান্তা’ অ্যান্ড্রু হলের কথাই সবার আগে মাথায় আসে। বুলেটও যেখানে তাঁকে পারেনি দমাতে, সেখানে কুম্বলে, হরভজনরা আর কী করবেন!