কিং অব স্যুইং

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ১৯৩০ এর দশক ছিল ব্যাটিং দশক। ব্র্যাডম্যানের দশক, হ্যামন্ডের দশক। অবশ্য মাঝখানে একবার বডিলাইন সিরিজ এসেছিলো। কিন্তু সে তো নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিশ্বযুদ্ধ উত্তর যে ব্যাট ও বলের লড়াইতে কিছুটা সাম্য এলো, তার অন্যতম কান্ডারি লিন্ডওয়াল।

তিনি একসময় চুটিয়ে রাগবি খেলতেন। আবার ক্রিকেটটাও মন্দ খেলতেন না। ক্রিকেটটা খেলতেন এমন একটা জায়গায় যেখান দিয়ে বিল ওরাইলি রোজ বাড়ি যেতেন। এই আশায়, যে একবার ওরিলি নজরে পরে যাবেন। তা গেলেন ও। অতঃপর তাঁর রাগবি জীবনে তালা। ওরাইলীর কথাতেই রাগবি ছেড়ে ক্রিকেটে মন দেন। হাটন, কম্পটনরা বোধহয় তিনি রাগবি খেললেই খুশি হতেন। তাহলে তাঁদের আর তাঁর লেট-সুইং গুলো খেলতে হতো না। যাঁর কথা হচ্ছে তিনি রে লিন্ডওয়াল, পুরো নাম রেমন্ড রাসেল লিন্ডওয়াল। জন্ম ১৯২১ সালের তিন অক্টোবর।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ১৯৩০ এর দশক ছিল ব্যাটিং দশক। ব্র্যাডম্যানের দশক, হ্যামন্ডের দশক। অবশ্য মাঝখানে একবার বডিলাইন সিরিজ এসেছিলো। কিন্তু সে তো নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিশ্বযুদ্ধ উত্তর যে ব্যাট ও বলের লড়াইতে কিছুটা সাম্য এলো, তার অন্যতম কান্ডারি লিন্ডওয়াল।

তাঁর অ্যাকশন আউটস্যুইং বোলিংয়ের জন্যে আদর্শ ছিল। মোটামুটি ৪৫ ডিগ্রি কোন থেকে নামতো। কিন্তু তবুও তাঁর সিংহভাগ উইকেট ছিল বোল্ড। এটা উল্লেখ করার কারণ আর কিছুই না, শুধু ওঁর পেস বোলিং বৈচিত্র ও ক্লাসটাকে বোঝানো। ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্টে মানুষ প্রধানত দুটি চরিত্রকেই মনে রেখেছে। এক, ব্র্যাডম্যান নিজে। দুই, তাঁর উইকেট পাওয়া এরিক হোলিস। কিন্তু সেই টেস্টেই যে ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মাঠে এশেজ ক্রিকেটে তাদের সর্বনিম্ন স্কোরটি করে, এই ব্যাপারটা সবাই একপ্রকার ভুলে মেরে দিয়েছে। সেই ৫২ অল-আউটের পিছনে তো লিন্ডওয়ালের ৬ উইকেটই ছিল।

বিল ওরিলি ছিলেন লিন্ডওয়ালের গুরু। ওরিলির ক্লাব, সিডনির সেন্ট জর্জে তিনি ছবি তুলে লিন্ডওয়ালকে তাঁর একশানের খুঁত বোঝাতেন। ক্রিকেটের চরম মনোযোগী ছাত্র, লিন্ডওয়াল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। অনুশীলনে নিরলস ছিলেন। তৎকালীন বহু ক্রিকেটারের মতো লিন্ডওয়ালও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যান। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে পোস্টেড থাকাকালীন কিছু অসুস্থতার কারণে ছুটি পেয়েছিলেন। তা সেইসময় দুটি পামগাছের মাঝখানে নিজের রান-আপ বানিয়ে অনুশীলন করতেন। নিজের বোলিংকে আরো নিখুঁত, ক্ষুরধার করার জন্যে।

ব্যক্তি জীবনে অবশ্য লিন্ডওয়াল নিখুঁত বা ক্ষুরধার কোনোটাই ছিলেন না। ম্যাচের শেষে ক্লান্তি কাটাতে বেশ কয়েক বোতল বিয়ার খেয়ে প্রতিবার সবার শেষে মাঠ ছেড়ে বেরোতেন। এই বিয়ারপ্রীতি পরে তাঁর মধুমেহর অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়। ডাক্তার তাঁর বিয়ারের কোটা দিনে তিনটিতে সীমাবদ্ধ করে দেন। তাঁর পায়ের একটি আঙুল মধুমেহ কেড়ে নেয়। প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেট লিখিয়ে ডেভিড ফির্থের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন রে।

তা একবার ব্রিসবেনে টেস্ট ম্যাচ সবে শুরু হবে। অর্থাৎ সকাল ১০-১০:৩০। পানরত লিন্ডওয়ালকে ফির্থ জিজ্ঞেস করেন, ‘এটা কত নম্বর হলো?’ লিন্ডওয়াল বললেন, ‘তিন’। ফির্থের চোখ কপালে। এখনো পুরো দিন বাকি। লিন্ডওয়ালের উত্তর, ‘আরে কোনো ব্যাপার না। দিব্যি আছি। চিন্তার কারণ নেই।’

ফির্থের লিন্ডওয়ালকে নিয়ে মুগ্ধতা শেষ হয় না। যুবক ফির্থ একবার সিডনিতে তাঁর স্বপ্নের নায়ককে অটোগ্রাফ নেবার পর অনুরোধ করলেন তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দিতে। আজকের দিনে এমন সুযোগই নেই। সবাই খেলা শেষে টিম বাসের খাঁচায় চুপচাপ ঢুকে যায়। তখন সময়টাই অন্য। লিন্ডওয়াল বিনা দ্বিধায় ফির্থকে গাড়িতে করে ছেড়ে দিলেন। ফির্থ লিখেছেন, ‘মনে প্রাণে চাইছিলাম গাড়িটা বিগড়ে যাক। তাহলে আরো কিছুটা সময় তাঁর সাথে থাকতে পারি।’

লিন্ডওয়াল এর চরিত্র এক কথায় বোঝাতে গেলে একটা ইংরেজি (বা বাংলা) শব্দ একেবারে খাপে খাপ বসে যায়-মাইডিয়ার। শোনা যায় একবার এক তরুণ অস্ট্রেলিয় বোলার নেশাতুর অবস্থায় বিভিন্ন পরিসংখ্যানের চর্বিত-চর্বন করে লিন্ডওয়ালকে প্রমান করে দেন, তিনি সেরা নন। লিন্ডওয়াল পুরোটা শুনে একটা ছোট্ট উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, তুমি বোধহয় ঠিকই বলছো।’

কোনো দিক দিয়েই লিন্ডওয়াল তাঁর ‘পার্টনার ইন ক্রাইম’ কিথ মিলারের মতো উচ্ছল নন। বিতর্কিত নন। কাগজের মুখরোচক কপি তাঁকে নিয়ে বানানো যাবে না। কিন্তু সতীর্থ ও বিপক্ষর তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা। জন ওয়ার বলেছেন, ‘আমাকে যদি কোনো ক্রিকেটীয় শেষ ইচ্ছা বাছতে বলা হয়, আমি বিনা দ্বিধায় লিন্ডওয়াল কে টেস্ট ম্যাচে বোলিং ওপেন করতে দেখতে চাইবো।’

খেলা ছাড়ার পর স্ত্রীর সাথে ব্রিসবেনে একটি ফুলের দোকান দেন। তখন তাঁকে দেখলে বোঝার উপায় ছিল না, যে আজকের গোলাপ ব্যবসায়ী গতকাল বিপক্ষকে তাঁর বোলিংয়ের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link