করোনা ভাইরাস ধীরে ধীরে শরীরে গ্রাস করছিল। প্রথমে জ্বর, মাথা ব্যাথা! ধীরে ধীরে তিনি অনুভব করলেন তার শরীরে কিছু একটা খারাপ হচ্ছে। লক্ষণ দেখে ধারনাও করছিলেন করোনার। এরপর তার স্ত্রী তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে। ডাক্তাররা ব্লাড টেস্ট করানোর পর তাকে জানায়নি তার কি কি সমস্যা!
শুধু বলেছিলেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি, তাই আইসোলেশনে থাকবেন। এরপর জানলেন করোনার সাথে সাথে, তিনি ম্যালেরিয়া আক্রান্ত সেই সাথে একধরনের বিষাক্ত পোকার কামড়ে তার এত জ্বর! শঙ্কা মুখেই ডাক্তাররা জানালেন ৩ থেকে ৬ মাস তাকে খেলার বাইরে থাকতে হবে।
তখনো কি তিনি জানতেন এই অসুস্থতা তার শরীরে এতোটাই গ্রাস করবে যে তিনি মাত্র ৩২ বছর বয়সেই এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিবেন! হ্যাঁ, ইনজুরি আর রোগের কাছে পেরে উঠলেন না তিনি। নিজ শরীরকে খেলার উপযুক্ত মনে না করায় মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
পুরো নাম কাইল ম্যালকম জার্ভিস। বাবা পিটার ম্যালকম জার্ভিস নিজেও ছিলেন জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলা সাবেক ক্রিকেটার। জিম্বাবুয়ের হয়ে ১৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলেছেন পিটার ম্যালকম জার্ভিস ৷ বাবা ক্রিকেটার হওয়ায় ছেলের ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁকটা স্বাভাবিক।
আর সেই ঝোঁককে স্বপ্নে পরিণত করতে ছুটতে থাকেন অদম্য গতিতে। ক্রিকেটের পাশাপাশি রাগবিতে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত ৷ এমনকি রাগবি অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও খেলেছেন তিনি। তবে বাবার পেশাকে আপন করে নিয়ে বেছে নিলেন ক্রিকেট।
মূলত গতি দিয়েই তিনি নজর কেড়েছিলেন সাবেক জিম্বাবুয়ের লিজেন্ড হিথ স্ট্রিকের। আর তার হাত ধরেই শুরু হল জাতীয় দলের পথ চলা। ২০০৮ সালে জিম্বাবুয়ের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে খেলেন জার্ভিস। দলের সেরা বোলার হিসেবেই বিশ্বকাপে খেলেছিলেন তিনি। এরপর ২০০৯ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন এই পেসার।
ম্যাশোনালান্ড ইগলসের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই তিনি ৬৬ রানে শিকার করেন ৬ উইকেট! এরপর কেনিয়ার বিপক্ষেই ওয়ানডেতে অভিষেক হয় তার। ১৪০ গতিতে টানা বল করতে পারতেন তিনি, বেশ কয়েকবার ১৪৫ গতিতেও বল করায় মূলত নির্বাচক এবং কোচের তার দিকে আলাদা দৃষ্টি ছিল।
চার বছর জিম্বাবুয়ের জার্সিতে খেলেন তিনি। এর মাঝে ২০১১ সালে প্রায় ছয় বছর পর টেস্ট খেলতে নামে জিম্বাবুয়ে, আর সেই ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে সাদা পোশাকে জিম্বাবুয়ের সাথে সাথে অভিষেক হয় এই পেসারের৷ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে তখন থেকেই আর্থিক অবস্থার করুণ দশা। ক্রিকেটাররা ঠিকমত বেতন ভাতা পান না, সুযোগ সুবিধাতো আরো দূরের ব্যাপার! তাই জার্ভিস সিদ্ধান্ত নিলেন নিজ দেশ ছেড়ে কাউন্টিতে খেলবেন। ব্যাস যেই ভাবা সেই কাজ। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে ছেড়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে।
সেখানে ল্যাঙ্কাশায়ারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। নিজের প্রথম মৌসুমেই বেশ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন তিনি। তবে ইনজুরির কারণে বার বার বেগ পেতে হতে থাকে। চার বছর নিজ দেশ ছেড়ে কাউন্টিতে খেলেন তিনি। ইনজুরির সাথে লড়াই করে এরপর আবারো ২০১৭ সালে ফিরে আসেন দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে।
সুযোগ সুবিধা নেই, বেতন ভাতার কোনো ঠিক নেই সব জেনে বুঝেই সতীর্থদের সাথে নেমে যান ২২ গজে। বাবার খেলে যাওয়া লাল জার্সি গায়ে জড়িয়ে খেললেন আরো চার বছর! কিন্তু ইনজুরি আর অসুখের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলেন ৩২ বছর বয়সী এই জিম্বাবুইয়ান তারকা।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১৩ টেস্টে নিয়েছেন ৪৬ উইকেট। ৩ বার নিয়েছেন ফাইফর, যার মধ্যে ৯৮ রানে ৭ উইকেট ক্যারিয়ার সেরা। ওয়ানডেতে ৪৯ ম্যাচে ৫৮ উইকেট, ক্যারিয়ার সেরা ১৭ রানে ৪ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে ২২ ম্যাচে নিয়েছেন ২৮ উইকেট। এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে ২৩১ ম্যাচে শিকার করেছেন ৪৯২ উইকেট! ১৯ বার পাঁচ উইকেট আর ২ বার নিয়েছেন দশ উইকেট। ব্যাট হাতে পুরো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একটি ফিফটির দেখা পেয়েছেন তিনি।
ক্যারিয়ারে উল্লেখ করবার মত খুব বড় কিছু হয়তো তিনি করতে পারেননি। এক সময়ের তারকাবহুল জিম্বাবুয়ে দলের বর্তমান দুর্দিনে জার্ভিসের মত খেলোয়াড় থাকাটা সত্যি সৌভাগ্যের। তাঁর গতি আর নিঁখুত লাইন-লেন্থ তাঁকে যেভাবে দলে এনেছিল, সেই গতিতেই অনেক আগেই ক্যারিয়ারের শেষটা দেখে ফেলেছিলেন তিনি, ২০২১ সালে। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের গুটি কয়েক নক্ষত্রের মধ্যে হুট করেই পতন হয় এক জ্বলন্ত নক্ষত্রের! আর এটাই যেন এখন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের কঠিন বাস্তবতা।