মেসি-রোনালদো: ওয়ান লাস্ট ডান্স

লম্বা চুলের ক্ষুদে লিওনেল মেসি থেকে আজকের দিনের পরিণত এক রুপকথা। আবার কোকড়ানো চুলের তরুণ রোনালদো থেকে একটা পুরো এক মহাকাব্য।

একটা ঘোরের মধ্যে ছিল গোটা বিশ্ব। মাতাল এক পরিবেশ। দু’টো খেলোয়াড় যে পরিবেশ সৃষ্টির অন্যতম কারিগর। একজন ভিনগ্রহের এলিয়েন তো আরেকজন তো রীতিমত এক যন্ত্র। ল্যাতিন আমেরিকার নান্দনিক ফুটবলের বিস্তার ঘটিয়েছেন তো আরেকজন ইউরোপীয় পাওয়ার ফুটবলের ধারক হয়ে বিচরণ করেছেন। এই দুই মহারথী পৌঁছে গিয়েছেন নিজেদের ক্যারিয়ারের শেষভাবে। হয়ত নিজেদের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটাই খেলতে চলেছেন তাঁরা। বয়স অন্তত সে ইঙ্গিত দেয়।

এত আলোচনার পর নিশ্চয়ই মনে আর কোন সংশয় থাকে না, ঠিক কাদের নিয়ে কথা হচ্ছে। লম্বা চুলের ক্ষুদে লিওনেল মেসি থেকে আজকের দিনের পরিণত এক রুপকথা। আবার কোঁকড়ানো চুলের তরুণ রোনালদো থেকে একটা পুরো এক মহাকাব্য। মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে চার চারটি বিশ্বকাপ। চতুর্থ ও পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে তাঁরা দুইজন খেলতে চলেছেন নিজেদের পঞ্চম বিশ্বকাপ। এই দুই কিংবদন্তির দ্বৈরথটা উপভোগ্য ছিল বেশ। এমনকি এই দুইজন একই সাথে শুরু করেছিলেন তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা।

সেই ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ থেকে শুরু তাদের পদযাত্রা। এখনও বহাল তবিয়তে চলমান সে যাত্রা। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের নিয়ে কাঁটাছেড়া হয়েছে বেশ। কে কার থেকে এগিয়ে এই নিয়ে আলোচনার পরিসমাপ্তি যেন টানতে পারেনি কেউ। তাঁরা দুইজনও নিজেদের মধ্যে চলমান রেখেছিলেন নিজেদের মধ্যে এক তুমুল লড়াই। আজ মেসি এগিয়ে যাচ্ছে তো কাল রোনালদো। এই দ্বৈরথের মুগ্ধতার শেষ নেই। একবিংশ শতাব্দীর শুরু দিককার ফুটবল সমর্থকরা তো নিজেদের সত্যিকার অর্থেই ভাগ্যবান মনে করেন।

ক্লাব ফুটবলে মেসি-রোনালদোর পার্থক্য খুঁজে বেড়ানোটা নিত্যদিনের ঘটনা। বিশ্বকাপ আসন্ন, বিশ্বকাপ মঞ্চে এই দুই মহাতারকার পারফরমেন্স নিয়ে একটু আলোচনা না হলে নিশ্চয়ই অপূর্ণতা থেকে যায়। তাইতো, ২০০৬ বিশ্বকাপের দিকেই নজর দেওয়া যাক। তখনও আর্জেন্টিনা দলের মেসি নিয়মিত নন। বার্সেলোনার হয়ে সবে মাত্র আলো কাড়তে শুরু করেছেন। বিশ্বকাপের আগে কেবল সাতটি ম্যাচে তিনি আর্জেন্টিনার আকাশি নীল জার্সিটি গায়ে জড়িয়েছিলেন।

তবুও বিশ্বকাপের মঞ্চে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমেই করেন বাজিমাত। সেবার সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোর বিপক্ষে বিশ্বকাপ অভিষেক হয় তাঁর। ৭৫ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নেমে হার্নান ক্রেসপোকে সহয়তা করেন দলের ব্যবধানটা ৪-০তে নিয়ে যেতে। ঠিক সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। আর্জেন্টিনার ৬-০ গোলের বিশাল জয়ে একটি গোলে ছিল তাঁর অবদান। ১৯৬৬ সালের পর কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চের এক ম্যাচে গোল ও অ্যাসিস্ট করা একমাত্র খেলোয়াড় তিনি।

এরপর সর্ব সাকুল্যে ৩০ মিনিটের খানিক বেশি খেলার সুযোগ পান দ্বিতীয় রাউন্ডে। কোয়ার্টার ফাইনালের তাঁর দল বিদায় নেওয়ার ম্যাচে, তরুণ মেসি সাইড লাইনে বসেই দলের হার দেখেছেন। অন্যদিকে মেসি যখন সবেমাত্র ধ্রুবতারা হতে শুরু করেছেন, তখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তীব্র আলোর প্রতিফলনই ঘটাচ্ছিলেন। রেড ডেভিলদের হয়ে বিশ্বকাপের আগের মৌসুমেই ১৫ গোলে অবদান ছিল তাঁর। এছাড়া পর্তুগালের হয়ে ৩২ খানা ম্যাচে ১১ খানা গোলও আদায় করেছিলেন।

সেই ট্যালির সাতখানা গোল তিনি আদায় করেছিলেন বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কাছে প্রত্যাশা ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। তবে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঠিকঠাক ঘটাতে পারেনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সেই বিশ্বকাপে কেবল একটি মাত্র গোল তিনি করেছিলেন, ইরানের বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল আদায় করেছিলেন রোনালদো। এরপর তাঁর দল সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছালেও তিনি আর জালের দেখা পাননি।

মেসি ও রোনালদো দুইজনের গোলের সংখ্যা এক হলেও সুযোগ তৈরিতে এগিয়ে ছিলেন রোনালদো। অধিক সময় তিনি খেলেছেন সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হয়। তবে রোনালদো আবার পিছিয়ে ছিলেন অ্যাসিস্টে। সুতরাং খুব যে বেশি তফাৎ দুইজনের প্রথমের বিশ্বকাপ পারফরমেন্সে রয়েছে সেটা বলবার সুযোগ নেই। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে এই দুই মহারথীর প্রথম বিশ্বকাপ যাত্রার।

এরপর তো গোটা বিশ্ব ফুটবল নিজের নিয়মে চলে থাকে। ক্লাব ফুটবলে রীতিমত তাণ্ডব চালাতে শুরু করেন লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ২০১০ বিশ্বকাপে স্বাভাবিকভাবেই এই দুই খেলোয়াড় বনে যান তাদের নিজ নিজ দলের মুখ্য চরিত্র। কেননা, বিশ্বকাপের আগেই এই দুইজন জিতে ফেলেন ব্যালন ডি’অর। মেসি জেতেন ২০০৯ সালে, আর রোনালদো স্বর্ণালী বলে হাত রাখেন ২০০৮ সালে।

তাছাড়া স্প্যানিশ লা লিগাতে মেসির ৩৪ গোলের বিপরীতে রোনালদোর ২৬টি। ক্লাব পর্যায়ে লড়াইটা হয়েছে দারুণ। তাই তো পুরো বিশ্ব অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিল এই দুই জনের জম্পেশ লড়াই দেখবার উদ্দেশ্যে। তবে আবারও ফুটবল সমর্থকদের হতাশ হতে হয়। কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি সেবার আর্জেন্টিনার যাত্রায় মেসি পুরোটা সময়ই ছিলেন সবুজ ঘাসে। কিন্তু মেসির ম্যাজিক কোথাও একটা ছিল মিসিং। রাউন্ড অব সিক্সটিনে মেক্সিকোর বিপক্ষে একটি অ্যাসিস্টেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল সেবার মেসি ভক্তদের। পুরো আসরে একটি মাত্র গোলেই অবদান ছিল তাঁর।

তবে সুযোগ তৈরিতে তিনি একদফা এগিয়ে ছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চাইতে। অন্যদিকে, রোনালদোর বিশ্বকাপ যাত্রাও যে খুব একটা সুখকর ছিল সেটা বলবার সুযোগ নেই। যতটা বিধ্বংসী ফর্ম নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে, ঠিক ততটা ধ্বংসলীলা চালাতে পারেননি ক্রিশ্চিয়ানো। কোনমতে গ্রুপ পর্বের বাঁধা অতিক্রম করে পর্তুগীজরা। উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ৭-০ ব্যবধানের বড় জয়ে একটি গোল করার পাশপাশি একটি অ্যাসিস্ট করেন রোনালদো। ব্যাস! ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পর্তুগালের অধিনায়ককে।

এরপর অবশ্য তাদের দ্বৈরথ থেমে থাকেনি, এগিয়ে গিয়েছে আপন গতিতে। সে দ্বৈরথের মুকুটে যুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন পালক। রুপকথার মহাকাব্যিক গল্প বুনে গিয়েছেন তাঁরা, ঠিক যেন গ্রাম বাংলায় বোনা নকশি কাঁথা। দুই জনের নিজেদের ক্লাব ক্যারিয়ারকে করেছেন আরও বেশি সমৃদ্ধ। প্রতিযোগিতাকে সঙ্গ করে নিয়ে ব্রাজিলে হাজির ফুটবল মহাকাশের দুই উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তবে এবার ইনজুরি জর্জরিত রোনালদোর যাত্রা থেমে যায় গ্রুপ পর্বেই। ২০১৪ আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে ৪-০ ব্যবধানে প্রথম ম্যাচ হারে পর্তুগাল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র্যের সাথে ড্র। শেষ ম্যাচে ঘানার বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেন ক্রিশ্চিয়ানো। এক গোল ও এক অ্যাসিস্টে সেবারের বিশ্বকাপ যাত্রায় দাড়ি টেনে বাড়ি চলে যান রোনালদো। অন্যদিকে ভিন্নচিত্র আর্জেন্টিনা শিবিরে। অভাবনীয় এক পথ ধরে আর্জেন্টিনা নিজেদের খুঁজে পায় বিশ্বকাপের ফাইনালে। আর্জেন্টিনা নামক গাড়িটির চালকের আসনে ছিলেন যথারীতি লিওনেল মেসি। তবে আফসোস, ১১২ মিনিটে জার্মান স্ট্রাইকার মারিও গোৎজের করা গোলে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় আলবেসেলেস্তাদের।

ব্রাজিলের মাটিতে, আপন রুপেই যেন আবির্ভূত হয়েছিলেন মেসি। গ্রুপ পর্বে চার খানা গোলও করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে গোল বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই আসরেই আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিলেন লিওনেল মেসি। পুরষ্কার স্বরুপ গোল্ডেন বল জিতেছিলেন বাঁ-পায়ের জাদুকর। তবে সেটা নিয়েও হয়েছে নানান সমালোচনা। সবকিছু ছাপিয়ে ১৯৯০ সালের পর আবারও শিরোপা হারের গ্লানি নিয়ে বাড়ি ফেরে ল্যাতিন আমেরিকান দেশটির ফুটবলাররা।

এরপরও ক্রিশ্চিয়ানো আর লিওনেল মেসি দুই জনে নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে মুগ্ধতা ছড়াতে থাকেন। বছর ঘুরে, চার বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের আয়োজন বসে রাশিয়াতে। যথারীতি নিজের দল ও প্রত্যাশার পাহাড় নিয়ে হাজির হন রোনালদো ও মেসি। তবে মেসি বা রোনালদো কারও যাত্রাই সেবার সুখের বার্তা বয়ে নিয়ে আসেনি দলগতভাবে। মেসি নিজের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেন। একই ফলাফলের সম্মুখীন হন ক্রিশ্চিয়ানো।

ব্যক্তিগতভাবে ২০১৮ বিশ্বকাপে রোনালদো রেকর্ড গড়েন। সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে হ্যাট্রিক করবার রেকর্ডটা নিজের করে নেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তবুও তিনি স্পেনের কাছ থেকে নিজ দলকে রক্ষা করতে পারেননি। অন্যদিকে মেসি ফ্রান্সের বিপক্ষে দুইটি গোল তৈরি করে দিয়েছিলেন। তবুও শেষ অবধি ফ্রান্স নামক বাঁধা অতিক্রম করতে পারেননি মেসি।মনঃক্ষুণ্ণ হয়েই দুই মহাতারকা বিদায় নেন বিশ্বকাপ আসর থেকে।

তবে আবার নতুন এক স্বপ্নে বুক বেঁধেছে এই দুই তারকার সমর্থকরা। নিঃসন্দেহে এটাই হতে চলেছে এই দ্বৈরথের শেষ বিশ্বকাপ। দুইজনই চাইবেন ২০২২ কাতার বিশ্বকাপটা মাতিয়ে রাখতে। সেক্ষেত্রে অবশ্য মেসির সম্ভাবনাই বেশি। তাঁর দলটা বেশ দারুণ একটা ছন্দে রয়েছে। সে সাথে মেসি নিজেও রয়েছেন ফর্মে। প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের হয়ে মৌসুমটা ভালই কাটাচ্ছেন মেসি। সে ভাল সময়টা নিশ্চয়ই বিশ্বকাপের মঞ্চেও উজাড় করে দিতে চাইবেন। তাছাড়া তাঁর উপর থেকে চাপটা এখন অনেকটাই কম।

অন্যদিকে একদমই ভাল সময়ের মধ্যে নেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে রয়েছে রীতিমত নিজের ছায়া হয়ে। দল কিংবা কোচের সাথেও সম্পর্কটা খুব একটা ভাল নেই। এবারের মৌসুমে মাত্র একবার তিনি খুঁজে পেয়েছেন জালের ঠিকানা। খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগও মেলেনি তাঁর। দলের প্রত্যাশার চাপ মেটানোর পাশাপাশি নিজেকে শেষ বারের মত প্রমাণের একটা বাড়তি চাপ নিশ্চয়ই থাকবে রোনালদোর উপর। সে সবকে পাশে রেখে রোনালদো নিশ্চয়ই চাইবেন নিজের দানবীয় রূপে পুনরায় ফিরতে।

তবে সমস্যা একটাই, এই দুই তারকা খেলোয়াড় বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে একটি গোলও করতে পারেননি নিজেদের চারটি বিশ্বকাপে। ২০০৬ সালে তাদের অভিষেকের পর থেকে এখন অবধি ১০৫ জন খেলোয়াড় তাদের দলের হয়ে নক আউট পর্বে গোল করেছেন। কিন্তু সম্মিলিত ১৬ খানা শট গোলবারে রেখেও মেসি-রোনালদো গোল আদায় করতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তাদের ব্যক্তিগত পারফরমেন্স বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিশ্চয়ই বলের দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

সকল পিছু টান, সকল বঞ্চনা আর ঝঞ্ঝাট ভুলে মেসি-রোনালদো আবার জ্বলে উঠবেন নিজেদের আপন ছন্দে। তাঁরা নিজেরাও হয়ত মুখিয়ে রয়েছেন। তারাও জানেন এটাই শেষ এবং লেটস হ্যাভ ওয়ান লাস্ট ডান্স।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...