চারিদিকে সমর্থকদের স্লোগান, খেলোয়াড়দের মধ্যে সদ্যই শেষ হলো হাতাহাতি। সাইড লাইন থেকে নির্দেশ এলো। অনায়াসে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই গোল করে বসলেন প্রতিপক্ষ এক খেলোয়াড়। অদ্ভুত ঠেকছে? স্বাভাবিক।
এমন ঘটনা তো আর সচারচর ঘটে না। তবে কালেভদ্রে ঘটে আর মানুষের মনে দাগ কেটে রেখে যায়। মনে থেকে যায় বহুকাল। মেলে সম্মাননাও। নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে মনে, কি এমন ঘটেছিলো সেদিন?
ঘটনা না বলে গল্প বলা যেতে পারে। উদারতার গল্প কিংবা ত্যাগের। গল্পটার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব লিডস ইউনাইটেড কিংবা ২০১৮/১৯ মৌসুমে থাকা তাঁদের আর্জেন্টাইন কোচ মার্সেলো বিয়েলসা।
সেই মৌসুমের ইংলিশ ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়নশিপে শীর্ষে দুই উঠে আসার সুযোগ ছিলো লিডস ইউনাইটেডের সামনে। তাঁরা ছিলো প্রিমিয়ার লিগে সরাসরি প্রমোশনের সুযোগ একেবারে দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু তাঁদের মহানুভবতা তাঁদেরকে নিয়ে যায় প্লেঅফে।
শুধু শেষের দিকে বাকি থাকা দুই ম্যাচে জেতা ছাড়াও লিডসকে তাকিয়ে থাকতে হতো শেফিল্ড ইউনাইটেডের দিকে। তাঁদেরকে হারতে হতো অথবা ড্র করতে হতো। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো লিডসের দুইটি জয়। এমন এক সমীকরণকে সামনে রেখে অ্যাস্টন ভিলার মুখোমুখি হয়েছিলো লিডস।
নিজেদের শেষ ম্যাচের ঠিক আগের ম্যাচের কথা। সেই ম্যাচেই পুরো বিশ্ব দেখেছিলো মহানুভবতার অনন্য দৃষ্টান্ত। যার জন্যে ফিফা ২০১৯ সালে ‘ফেয়ার প্লে’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেছিলো তৎকালীন লিডস কোচ বিয়েলসা ও তাঁর পুরো দলকে।
অ্যাস্টন ভিলা ও লিডস এই দুই দলের মধ্যে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। ৭১ মিনিট অবধি গোলের দেখা পায়নি কোন দল। ৭৩ মিনিটে অসাধারণ কার্ভ শটে গোল করেন লিডস ইউনাইটেডের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় ম্যাথিউস ক্লিচ।
কিন্তু, এর আগেই অ্যাস্টন ভিলার খেলোয়াড় জনাথন কদিজা সম্ভাব্য মাথার ইনজুরি নিয়ে মধ্যমাঠে শুয়ে পড়েছিলেন। যেহেতু রেফারি খেলা থামানোর কোন নির্দেশ দেননি, সেহেতু লিডসের খেলোয়াড়েরা খেলা চালিয়ে গোল আদায় করে নেন। তবে অ্যাস্টন ভিলার খেলোয়াড়েরা ভেবেছিলেন হয়ত লিডসের খেলোয়াড়েরা থামাবেন খেলা।
অগ্যতা বেঁধে যায় কথার লড়াই। সেটা গড়ায় হাতাহাতি অবধি। পুরো স্টেডিয়াম ততক্ষণে সরগরম হয়ে যায়। লিডসের ঘরের মাঠের দর্শকেরা ক্ষিপ্ত হতে শুরু করে। স্টেডিয়াম জুড়েই এক বিশৃংঙ্খলার আশঙ্কা বয়ে যেতে থাকে। কথার লড়াই চলে দুই দলের ডাগ আউটেও।
ম্যাচ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ম্যাচ রেফারিও নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করেন খেলোয়াড়দের মাঝে হওয়া হাতাহাতির ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটাতে। শেষমেশ খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝামেলা মিটে আবার খেলা পুনঃরায় শুরু হয়।
এর আগে অবশ্য ভিলার আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আনোয়ার এল গাজি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। তাঁকে লাল কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্তও ছিলো বেশ বিতর্কিত। লিডসের খেলোয়াড় প্যাট্রিক ব্যামফোর্ডের গায়ে হাত তোলার অপরাধে গাজিকে লাল কার্ড দেখান রেফারি।
তবে, খুব বেশি গুরুতর অপরাধ করেননি গাজি। ম্যাচের রিপ্লাইতে অন্তত তাই দেখা গিয়েছে। সেই যাই হোক ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই লিডস কোচ মার্সেলো বিয়েলসা তাঁর শীর্ষদের বলে দেন যেন তাঁরা অ্যাস্টন ভিলাকে যেন বিনা প্রতিরোধে একটি গোল করতে দেওয়া হয়।
লিডসের খেলোয়াড়েরা গুরুর কথা মেনে নিলেন এবং করতেও দিলেন গোল। ভিলার হয়ে অ্যালবার্ট অ্যাডোমা করেন গোলটি। অথচ সেই ম্যাচটি ড্র হলেই আর কোন সমীকরণ বাকি থাকে না শেফিল্ড ইউনাইটেডের সরাসরি প্রমোশনের।
এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বিয়েলসা ও লিডসের খেলোয়াড়দের মহানুভবতা তখন উত্তপ্ত লাভায় পরিণত হওয়া স্টেডিয়ামের দর্শকেরা মেনে নিতে পারেননি সহজে। তবে প্রশংসায় সেদিন ভেসেছিলো পুরো লিডস ইউনাইটেড ও তাঁদের আর্জেন্টাইন কোচ বিয়েলসা।
এমন ত্যাগ ক’জন মেনে নেয় বলুন! এমন মহানুভবতাও বা ক’জন দেখায়! এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করে দিয়ে গেলেন বিয়েলসা ও তাঁর শীর্ষ্যরা। সবকিছুর উপরে যে ‘দ্য বিউটিফুল গেম’ এবং সেই খেলাটা যে খেলতে হয় ভালোবেসে প্রতিপক্ষকে সম্মান করে তা শিখিয়েছেন বিয়েলসা। ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড তো তাঁর এবং তাঁর দলেরই প্রাপ্য।