‘বাজপাখি’ ডিকি বার্ড

ফুটবল খুব করে টানতো তাঁকে।

বিনি সুতোয় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন গেঁথে নেমে পড়েন ময়দানে। কিন্তু পেশাদার ক্লাব ফুটবলে টিকতে পারলেন না। স্বপ্নে বাধ সাধে চোট। ফুটবলার হতে পারেননি তো কি হয়েছে! ক্রিকেটটাও যে পাগলের মতোই ভালোবাসতেন। শেষে ফুটবল ছেড়ে ২২ গজের দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নেন। মনের আকর্ষণ থেকেই নাম লিখে ফেলেন ক্রিকেটে।

শুধু নাম লিখিয়ে ফেললেন না। খেলোয়াড় হিসেবে উল্লেখযোগ্য কেউ না হয়েও হয়ে গেলেন ক্রিকেট ইতিহাসের অমর এক চরিত্র। তিনি হ্যারল্ড ডেনিস বার্ড; আম্পায়ার ডিকি বার্ড।

ক্যারিয়ারের শুরুতে জিওফ বয়কটের একই দলে খেলতেন। ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে বার্ডের ভিতরে অপার সম্ভাবনা দেখেছিলেন এ ইংলিশ সুপারস্টার। কিন্তু স্নায়ুচাপ সামলাতে না পেরে সেটা আর হয়ে ওঠেনি তার জন্য। ক্যারিয়ারটা আর বর্ণিল করে তুলতে পারেননি।

ক্রিকেটার বনে গেলেও একটা স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় বার্ডের কাছে। আট-দশ জন ক্রিকেটারের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখার শখ ছিলো তারও। তবে সে আশায় গুড়ে বালি। প্রথম শ্রেণির ৯৩ ম্যাচ খেলে জাদুকরী তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছান মাত্র দুইবার। ২০.৭১ গড়ে তার ঝুলিতে জমা পড়ে ৩ হাজার ৩১৪ রান। এখানেও ঝুট-ঝামেলা পিছু ছাড়েনি সাবেক এ ইংলিশ ব্যাটসম্যানকে। ফুটবলের মতো হাঁটুর ইনজুরি ফের পিছু নিয়ে ফেলে। তাই তো ক্রিকেট খেলোয়াড়ি জীবনকে ৩১ বছরেই না বলে দিতে হয় খণ্ডকালীন এ অফ স্পিনারকে।

ডিকি বার্ড

খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেও ক্রিকেটের সঙ্গে বার্ডের সম্পর্কটা কিন্তু চিড় ধরেনি। জড়িয়ে পড়েন কোচিং আর লিগ ক্রিকেট খেলায়। ক্রিকেটের মায়াই তাকে থেকে যাওয়ার ভাবনার রসদ যুগিয়ে দেয়। সম্পর্কটা অটুট রাখার প্রয়াসে আম্পায়ারিংয়ে ক্যারিয়ার শুরু বার্ডের। এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে বনে যান জগদ্বিখ্যাত আম্পায়ার। বনে যান ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা আম্পারদের একজন। তবে শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠার পথটা মোটেও সহজ ছিল না।

১৯৩৩ সালে ইয়র্কশায়ারের বার্নসলের খনি শ্রমিক বাবার ঘরে জন্ম নেন হ্যারল্ড ডেনিস বার্ড। কিন্তু স্কুল জীবনে তার ডাক নাম হয়ে যায় ‘ডিকি’। তো তার পুরো গিয়ে দাঁড়ায়- হ্যারল্ড ডেনিস ‘ডিকি’ বার্ড। কিন্তু পড়াশুনায় মনোযোগ ছিল না বললেই চলে। যার চড়া মূল্য দিতে হয় ১১-প্লাস পরীক্ষায়। অকৃতকার্য হয়ে চলে যান সেকেন্ডারি মর্ডান স্কুলে। ১৯৪৮ সালে তখন তার বয়স মাত্র ১৫। সেখানেও তার মন টেকেনি। চাকরি নেন কয়লা খনিতে। এখানেও টিকতে পারেননি। বুঝে যান এ কাজ তাকে দিয়ে হবার নয়। শেষমেশ ক্রীড়ামোদি বার্ড ক্যারিয়ার গড়েন মাঠে।

তার আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারটা শুরু কাউন্টি ক্রিকেট দিয়ে। সেই ১৯৭০ সালে। তিন বছর বাদেই খেলোয়াড়ি জীবনের অপূর্ণতা ঝেড়ে ফেলেন এ ইয়র্কশায়ার লিজেন্ড। ক্রিকেটার হিসেবে যা পারেননি। আম্পায়ার হিসেবে সেটাই করে দেখান। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে ম্যাচ পরিচালনা করতে নেমে পড়েন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে। আম্পায়ার বার্ডের অভিষেকটা হয় লিডসে। ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার হেডিংলি টেস্ট দিয়ে।

সেই গ্রীষ্মে আরও দুটি টেস্ট ম্যাচ আম্পারিং করেন আগামী ১৯ এপ্রিল ৮৮ বছরকে স্বাগত জানাতে যাওয়া ‘ডিকি’। দুটি ম্যাচই ছিল বেশ ঘটনাবহুল।

প্রতি ওভার শেষেই আম্পায়াররা তাদের জায়গা বদল করেন। এটা ক্রিকেটের নিয়ম-নীতির মধ্যে পড়ে। কিন্তু ক্যারিবীয় খেলোয়াড়দের বাজে আচরণের প্রতিবাদে আর্থার ফাগ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এ কারণে এজবাস্টনের দ্বিতীয় টেস্টে পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি উচ্চতার বার্ডকে পরপর দুই ওভার আম্পায়ারিং করতে হয় বোলিং প্রান্তে। স্কয়ার লেগে নিয়ে নেন একজন বদলি আম্পায়ার।

লর্ডস টেস্টে ঘটে আরও এক মজার ঘটনা। গুজব ছড়িয়ে পরে চার দিকে। স্টেডিয়ামে বোমা রেখেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ)। দ্রুত খালি করা গ্যালারি। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের ‘এমবিই’ (১৯৮৬) এবং ‘ওবিই’ (২০১২)  পদকে ভূষিত বার্ড আর খেলোয়াড়রা জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়েন মাঠের ঠিক মাঝখানে। পরে ভুল ভাঙে। জানা যায়, পুরো ব্যাপারটাই ছিল ধাপ্পাবাজি!

দুটি কারণে আম্পায়ার হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বার্ডের। বাজে আবহাওয়ার অজুহাতে খেলা বন্ধ রাখায় তার জুড়ি মেলা ছিল ভার। এমনকি ব্যাটসম্যানদের এলবিডব্লিউ আউট দিতেন না। এলবিডব্লুউ আউট দিলেও সেটা একেবারেই কম। তবে একবার আউট দিলে সেটা আর মিস হতো না। তার চোখ ক্যামেরার লেন্সের মতো এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে ব্যাটারদের আউট নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতো না। বাজপাখির চোখের নিশানা যেমন কখনো ভুল হয় না, ঠিক তেমনি ডিকি বার্ডের আম্পায়ারিং চোখের টার্গেটও ছিল নিখুঁত। যেন হাল আমলের হক-আই প্রযুক্তি।

ভয়ঙ্কর বোলিংয়ের বিরুদ্ধে বার্ড সব সময় ছিলেন কড়া হেড মাস্টারের ভূমিকায়। বোলারদের ডেলিভারির ওপর সব সময় কড়া দৃষ্টি রাখতেন। সেটা শটপিস ডেলিভারি হোক বা হাই ফুলটস ডেলিভারি। পরিষ্কার জানিয়ে দেন দুটোর কোনোটাই তার হজম হয় না।

ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার শতবর্ষীয় টেস্টে সবার মধ্যমণি হয়ে যান লেস্টারশায়ারের কিংবদন্তি বার্ড। ১৯৮০ সালের লর্ডস টেস্টের শনিবারের রৌদ্রজ্জ্বল সকালেও খেলা শুরু করেননি বার্ড তার সহযোগী আম্পায়ার ডেভিড কনস্ট্যান্ট। কারণ আগের রাতের বৃষ্টির পানি তখনও আউটফিল্ডের কোথাও কোথাও জমে ছিল। পঞ্চমবার পিচ পরিদর্শন শেষে কনস্ট্যান্ট দু দলের অধিনায়ককে নিয়ে লং রুমে ফিরে গেলে চটে যান মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) সদস্যরা। এতকিছু ঘটে গেলেও বার্ড কিন্তু তখনো মাঠে। পিচ পরিদর্শনের তথ্য নোট করে চলে বেশ মনোযোগী ছাত্রের মতো।

শেষে খেলা মাঠে গড়ায় স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে। এজন্য কম কথা শুনতে হয়নি। পরে তো আম্পায়ারদের নিরাপত্তার মাঠে আসে পুলিশ।

ঝলমলে রোদ খেলা করছে। কিন্তু আগের দিনের বিরূপ আবহাওয়ার জন্য বার্ডের খেলা বন্ধ রাখার ঘটনা রয়েছে আরও। ১৯৮০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেডিংলি টেস্টেও এই কারণে খেলা বন্ধ রেখে ছিলেন। আউটফিল্ডের পানি পরিষ্কার করে তবেই মাঠে গড়ায় বল।

মাঠের বাইরের মজার ঘটনাও রয়েছে বেশ কয়েকটি। উইন্ডিজরা অভিষেক ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতা মাত্রই বাতাসের বেগে দল বেঁধে মাঠে ঢুকে পড়ে দর্শক। কয়েকজন ক্রিকেটার এবং আম্পায়ারদের সজ্জা-সামগ্রীর অনেক কিছু ‘স্মৃতিস্মারক’ হিসেব লুটে নেয় তারা। সেই লুটপাটের মাঝে তিন বিশ্বকাপ ফাইনালের আম্পায়ার বার্ড হারান শখের একটি হ্যাট।

ঠিক এক বছর পর তার সেই প্রিয় হ্যাটের খোঁজ মেলে। বার্ড একদিন সাউথ লন্ডনের বাসে ভ্রমণ করছেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে কন্ডাক্টরের মাথার শোভা পাওয়া হ্যাটে। চোখ পড়বেই। যেটা তার সাদা রঙের প্রিয় হ্যাটের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। কৌতহূলের আগুন তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তা নেভাতেই কন্ডাক্টরকে প্রশ্ন করেন- হ্যাটটা তিনি কোত্থেকে পেয়েছেন। লোকটার জবাব শুনে ৬৯ ওয়ানডের আম্পায়ার বার্ড যেন বিস্ময়ের ঘোরে আটকে যান।

কন্ডাক্টরের উত্তর, ‘মিস্টার, আপনি কি ডিকি বার্ডের নাম শোনেননি। এটা তারই একটি হ্যাট। উনিই আমাকে দিয়েছেন।’

অজানা একটি শক্তি ছিল লিজেন্ড আম্পায়ার বার্ডের মধ্যে। যেটা দিয়ে অনায়াসেই প্রাণোচ্ছল ক্রিকেটারদের আস্থা আর সম্মান অর্জন করে ফেলতেন। সঙ্গে চমৎকার রসবোধ ছড়িয়ে দিতেন অন্যদের মাঝেও। বলে বেড়াতেন, ‘আমার বিয়েটা হয়েছে ক্রিকেটের সঙ্গে! শুধু সংসার না করাটাই মিস করেছি। ধারণা করি, ভালো একজন বাবা হতে পারতাম।’

উদ্ভট সব কর্মকাণ্ডের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন চিরকুমার বার্ড। একদিন তো রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আসবেন শুনে মাঠে ৫ ঘণ্টা আগেই হাজির হয়ে যান।

ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট দিয়ে ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের সূর্য অস্ত যায় ইয়র্কশায়ারের সাবেক প্রেসিডেন্ট বার্ডের। এটা তার ক্যারিয়ারের ৬৬তম টেস্ট। যেটা ছিল তৎকালীন বিশ্ব রেকর্ড। ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একক কোনো দেশে সর্বাধিক টেস্ট পরিচালনার রেকর্ডটাও নেন নিজের দখলে। জন্মভূমি ইংল্যান্ডে ৫৪টি টেস্টে আম্পায়ার ছিলেন তিনি।

অবসর জীবনে আত্মজীবনী লিখেও ব্যাপক সাড়া ফেলেন বার্ড। তার ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’ গ্রন্থটির এক মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়। এখন সময় কাটছে তার সুবিধাবঞ্চিত অনূর্ধ্ব-১৮ ক্রিকেটারদের নিয়ে। তাদের ক্রিকেট মেধা বিকাশের সহায়তা করছে ডিকি বার্ড ফাউন্ডেশন।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link