তার নাম শুনলেই প্রথমে আপনার মনে পড়বে ফিক্সিং কান্ড।
বল হাতে কীর্তি গড়ে যেই মানুষটার থাকার কথা ক্রিকেটের গ্রেটদের সাথে, সেই মানুষটাই কিনা এখন স্মরনীয় হয়ে আছেন কেলেঙ্কারির জন্য!
হ্যাঁ, মোহাম্মদ আসিফের কথা বলছি।
বল হাতে তিনি ছিলেন রুপকথার এক জাদুকর। নিজের ভয়ংকর সুইংয়ে নাকানিচুবানি খাইয়েছেন বিশ্বের অনেক বড় তারকা ব্যাটসম্যানকে। বিশ্ব ক্রিকেটে এসেই জানান দিয়েছিলেন তিনি বল হাতে জাদু দেখাতে এসেছেন। ইনসুইং কিংবা আউটসুইং; দুই সুইংয়ের জন্যই আসিফ ছিলেন বিখ্যাত। তাঁর স্যুইং ভেলকিতে আটকা না পড়তে কত ব্যাটসম্যানই চাইতেন তার মুখোমুখি না হতে। সেই আসিফই কিনা ফিক্সিং কান্ডে জড়িয়ে নিজেকে শেষ করে দিলেন! অপার সম্ভাবনাময়ী এই পেসার ক্যারিয়ার শেষে কলঙ্ক ছাড়া নিজের নামের পাশে যোগ করতে পারেননি কিছুই!
১৯৮২ সালের ২০শে ডিসেম্বর পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শাইখুপুরা অঞ্চলে জন্ম হয় আসিফের। ছেলেবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হবে। প্রথমবার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান খান রিসার্চ ল্যাব দলের হয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ নৈপুণ্যে দেখিয়ে ডাক পেয়ে গেলেন জাতীয় দলে।
জানুয়ারি ২০০৫; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হলো টেস্ট ক্রিকেটে। তবে অভিষেক টেস্টে টা ছিলো দুঃস্বপ্নের মতোই। ১৮ ওভার বল করে সেই টেস্টে পাননি কোনো উইকেট। অজিরাও ৯ উইকেটের বড় জয় পায়। অভিষেক ম্যাচেই এমন পার্ফরমেন্স করে ছিটকে যান দল থেকে। তবে এক বছর পরই আবার ফিরলেন দলে।
ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে সুযোগ পেলেও পার্ফরমেন্স সেই সাদামাটা! ৩৪ ওভার বল করে নেন মাত্র ১ উইকেট। অবশ্য উইকেটটি ছিল যুবরাজ সিংহের। তৃতীয় টেস্টেও পেলেন সুযোগ, আর এই সুযোগেই করলেন বাজিমাত। সিরিজ নির্ধারনী সেই করাচি টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪ ও পরের ইনিংসে ৩ উইকেট নিয়ে নজর কাড়েন সবার। সেই সময়ের ত্রাস শচীন-শেবাগ-লক্ষণদের বোল্ড করে নিজের বোলিং জাদুর জানান দেন। সেই ম্যাচের সাথে সাথে পাকিস্তান জিতে নেয় সিরিজ।
পরের সিরিজেই আসিফ হয়ে ওঠেন আরো ভয়ংকর! লংকানদের বিপক্ষে ২য় টেস্টে নিলেন ক্যারিয়ার সেরা ৭০ রানে ১১ উইকেট! এরপরই সুযোগ পেলেন ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে লিস্টারশায়ারের হয় খেলার। লিস্টারশায়ায়ারের চেয়ারম্যান নিল ডেভিডসন আসিফকে নিয়ে বলেন, ‘bowler with the ability to generate great pace.’
পরের বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন আসিফ। দিনে দিনে নিজের ম্যাজিক্যাল বোলিংয়ে হয়ে উঠছিলেন আরো ভয়ংকর। তবে ক্যারিয়ার ধ্বংসের পিছনে শুধু ফিক্সিং কান্ডই নয়, বরং ড্রাগ ছিল তার ক্যারিয়ারের অন্যতম কালো ছায়া।
২০০৬ সালে নিষিদ্ধ ড্রাগ নেওয়ার ফলে তার আরেক সতীর্থ শোয়েব আক্তারের সাথে ২ বছরের জন্য শাস্তির মুখে পড়েন তিনি। পরে অবশ্য আপিল করায় শাস্তি কমানো হয় তার। পরে আরো কয়েকবার ড্রাগ নেওয়ায় শাস্তির মুখে পড়েন তিনি।
২০০৭ বিশ্বকাপের আগে অবশ্য ‘আনফিট’ ঘোষণা দিয়ে পিসিবি বাদ দেয় আসিফকে। সে বিশ্বকাপ খেলা হয়নি তার আরেক সতীর্থ শোয়েব আক্তারেরও। তার পেছনে কারণও আছে বটে। তবে আসিফ আর বিতর্ক যেন একসূত্রে গাঁথা। গুঞ্জন ছিল শোয়েবের সাথে বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে শোয়েব তাকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন। এতে অবশ্য পিসিবি কর্তৃক ৫ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞাও পান আসিফ।
এভাবেই একের পর এক বিতর্ক আর সমালোচনার জন্ম দিয়েই ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। যখনি বল হাতে ২২ গজে যখনি নামতেন তিনি ছিলেন বোলারদের জন্য আতংক। একবার দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট হাসিম আমলাকে জিজ্ঞেস করা হয় তার ক্যারিয়ারে দেখা সবচেয়ে কঠিন বোলার কে? জবাবে আমলা বলেন, ‘আমার ফেস করা সবচেয়ে কঠিন বোলার মোহাম্মদ আসিফ। আমি মনে করি, অনেকে এ ব্যাপারে আমার সাথে একমত হবেন যে, হি ওয়াজ দ্য ম্যাজিশিয়ান অফ দ্য বল।’
সাফল্য-বিতর্ক মিলে সবকিছুই তখনো ঠিকঠাক চলছিল।এরপরই এলো ক্রিকেট ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়।
২৬ আগস্ট, ২০১০ লর্ডসের রৌদ্রস্নাত দিনে ঘটলো কালো এক ঘটনা! ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডস গ্রাউন্ডে সেদিন স্মৃতির ক্যালেন্ডারে জায়গা পেল এক কলঙ্কময় দিন হিসেবে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ বাঁচাতে শেষ টেস্টে জয় দরকার পাকিস্তানের। টসে জিতে ফিল্ডিং নেয় পাকিস্তান, অভিনয়, নাটক কিংবা বিতর্কের শুরুটা এরপরই! প্রথম ইনিংসের ৩য় বলটি আমির করলেন নো বল। আমিরকে অনুসরণ করে ইনিংসের ১০ম ওভারে একই কান্ড দেখালেন বল হাতের জাদুকর মোহাম্মদ আসিফ।
এই ঘটনা মনে পড়লেই আপনার সামনে ভেসে উঠবে কিছু ফিক্সারের ছবি! যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোহাম্মদ আসিফ। লর্ডসের মাটিতে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কময় অধ্যায়ের রচনার অন্যতম কারিগর ছিলেন আসিফ! জুয়াড়ি মাজহার মাজিদের পূর্ব পরিকল্পিত ফাঁদে পা দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার শেষ করে দেন আসিফ।
যেই আসিফকে কিনা ওয়াসিম-ওয়াকার ইউনুস দের পরবর্তী সেরা পেসার ধরা হতো সেই আসিফই কিনা নিজ হাতে ধ্বংস করে দেন তার সম্ভাবনাময়ী সোনালী ক্যারিয়ার। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির এই দীর্ঘদেহীর খেলোয়াড়ের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতিটা এখানেই! ২০১১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি সালমান বাট, আমিরদের সাথে আইসিসির দূর্নীতি দমন কমিশন ইউনিটের রায়ে নির্বাসিত হন মোহাম্মদ আসিফ।
সে সময় ডেল স্টেইনের পরে টেস্ট ক্রিকেট বোলিং র্যাংকিংয়ের দ্বিতীয় সেরা বোলার ছিলেন মোহাম্মদ আসিফ। দুই দিকেই সুইং করানোর ক্ষমতা, অসাধারণ লাইন-লেংথ সবকিছুকে ছাপিয়ে আসিফ গায়ে জড়ালের ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কের দাগ। বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের যিনি ২২ গজে হাঁটু কাপিয়েছেন তিনিই কিনা বয়ে বেড়াচ্ছেন কলঙ্কের দাগ।
ক্যারিয়ারে মাত্র ২৩ টেস্ট খেলে উইকেট নিয়েছেন ১০৩ টি; ৫ উইকেট সাতবার ও ১০ উইকেট নিয়েছেন একবার। ইনিংস সেরা ৬ উইকেটে ৪১ রান। ৩৮ ওয়ানডেতে নিয়েছেন ৪৬ উইকেট; সেরা বোলিং ৩ উইকেটে ২৮ রান। টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ১১ ম্যাচ খেলে শিকার করেছেন ১৩ উইকেট; সেরা বোলিং ৪ উইকেটে ১৮ রান।
তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান দেখে আপনি কখনোই তাকে বিচার করতে পারবেন না তিনি বল হাতে প্রতিপক্ষের জন্য কতটা ভয়ংকর ছিলেন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রথম উইকেট মেইডেনের কৃতিত্বও তার।
২০১০ সালের ১লা অক্টোবর সানিয়া হিল্ললকে বিয়ে করেন আসিফ। বিয়ের পর বলেছিলেন তার জীবনে হয়তো পরিবর্তন আসবে পজিটিভ ভাবেই! কিন্তু এমন পরিবর্তন এলো যা হয়তো কখনো কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাববে না।
শুধু ক্রিকেটেই নয় আসিফের সুযোগ হয়েছিল ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউডে অভিনয় করার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরই তার বদলী সেই ছবিতে সুযোগ পায় কানাডিয়ান অভিনেতা আব্বাস হাসান।
বল হাতে দ্যুতি ছড়ানোর সুযোগ হয়তো তিনি হারিয়েছেন। লর্ডসের সাদা মেঘের নীল আকাশে তিনি যে কলঙ্কের দাগ এটেছেন তা তিনি এ জীবনে মুছতে পারবেন না। তাকে বলা হতো পরবর্তী গ্লেন ম্যাগ্রা। বল হাতে অপার সম্ভাবনাময়ী এই খসে পড়া জাদুকর হয়তো আজ থাকতেন গ্রেটদের পাশে। ভাগ্য, উদাসীনতা, ড্রাগ আর ফিক্সিং কান্ডে ক্রিকেট থেকে খসে পড়লো এক ধ্রুবতারা।