স্প্যানিশ আর্মাডার দক্ষ নাবিক

শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ম চোখ, ভয়ডরহীন মনোভাব নিয়ে একের পর এক প্রশ্নবাণের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন লুইস এনরিকে। মূলত এমন দৃশ্যের সাথে পরিচয় ঘটেছে তিনি ফুটবল কোচ বনে যাওয়ার পর। এর আগে অবশ্য তিনি ছিলেন ফুটবলার। তবে সেখানেও বেশ একটা মজার গল্প আছে তাঁর।

১৯৭০ সালের আট মে স্পেনে জন্ম তাঁর। স্পেনের ফুটবলের ইতিহাসে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র বলা যায় তাঁকে নির্দ্বিধায়। তিনি কিংবদন্তি। ফুটবলের তারকা হতে হলে যে কারিকারি গোল চাই কিংবা খেলোয়াড় হিসেবে ভুড়িভুড়ি শিরোপা চাই বিষয়টা তা নয়। ফুটবলের তারকা হওয়া যায় সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও। সে উদাহরণ তো খোদ লুইস এনরিকে।

তবে শুরু থেকে শুরু করা যাক। স্পেনের ছেলে এনরিকে। ফুটবলের সখ্যতা আর পাঁচটা ফুটবল পাগল ছেলের মতই একেবারে ছেলেবেলা থেকেই। স্থানীয় ক্লাব থেকে শুরু পরবর্তীতে তিনি খেলেছেন ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দুই ক্লাবের হয়ে। মজার বিষয় হল সে দু’টি ক্লাব আবার একে অপরের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্প্যানিশ ফুটবলের দুই পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা দুই দলের জার্সিই গায়ে জড়িয়েছেন এনরিকে।

প্রথমে অবশ্য তিনি ছিলেন লস ব্ল্যাঙ্কোস ডেরায়। সেখানটায় খুব একটা সুখের স্মৃতি নেই তাঁর। সমর্থকদেরও খুব একটা পছন্দের খেলোয়াড় তিনি হয়ে উঠতে পারেননি। তবে ‘ভার্সেটাইল’ এই ফুটবলার দমে জাননি কখনোই। যখন সুযোগ এসেছে তিনি দু’হাতে লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবুও যেন মাদ্রিদ সমর্থকদের মন ভরেনি। পাঁচটা মৌসুম তাঁর ঘর ছিল মাদ্রিদ।

তবে এ ঘর ছিল অস্থায়ী। পাঁচ মৌসুম শেষে তিনি কোনরকম ‘ট্রান্সফার ফি’ ছাড়াই যোগ দেন কাতালান শিবিরে। এরপরই যেন তিনি খুঁজে পান নিজের সত্ত্বাকে। প্রথম দিকে বার্সেলোনার সমর্থকরা তাঁকে মেনে নিতে না পারলেও সময়ের সাথে সমর্থকদের প্রচণ্ড মনে ধরে তাঁকে। বনে যান দলের আস্থাভাজন একজন ফুটবলার। প্রথম মৌসুমেই কাতালান ক্লাবটির হয়ে গোলের অর্ধ-শতক করেন এনরিকে।

এরপর তো আর তাঁকে দূরে ঠেলে দেওয়া যায়? যায় না। খুব করে আপন করে নিল তাঁকে বার্সেলোনা। বার্সাই যেন হয়ে গেল তাঁর পরম আবাসস্থল। তিনি পুরোদস্তুর কাতালান হয়ে গেলেন তিনি। বার্সেলোনার হয়ে খেলেন আটটি মৌসুম। বন্ধনটা অটুট থেকে যায়। খেলোয়াড়ি জীবনের অবসান ঘটিয়ে তিনি শুরু করেন কোচিং ক্যারিয়ার। শুরুটাও তিনি করেন বার্সেলোনা থেকে, বি দলের দায়িত্ব নিয়ে।

সেখান থেকে ইতালি ঘুরে আবার স্পেনে ফেরেন তিনি। এএস রোমা, সেলটিকের পর তাঁর কাঁধে তুলে দেওয়া হয় বার্সেলোনার মূল দলের দায়িত্ব। সেখানেই তিনি করেন বাজিমাত। তিনি দ্রুত আক্রমণ পন্থা অবলম্বর করেছেন প্রথম মেয়াদের চুক্তিতে। রক্ষণ থেকে দ্রুত বল আক্রমণে স্থানান্তর করার মত গতিশীল ফুটবল খেলিয়েছেন তিনি দলকে। মেসি, নেইমার, সুয়ারেজ নিয়ে গড়া আক্রমণ তাঁর সে পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছেন মাঠের ফুটবলে।

ফলাফল একের পর এক গোল প্রতিপক্ষের জালে। পেছন থেকে শিষ্যদের এমনই সব টোটকা দিয়েছিলেন যে চুক্তির প্রথম মৌসুমেই তিনি বার্সাকে জেতান ট্রেবেল। লা লিগা, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়াও তাঁরা তত্ত্বাবধানে কোপা দেল রেও জেতে বার্সেলোনা। প্রথম মৌসুমেই এমন সাফল্যের পর এনরিকে ভাসেন প্রশংসার জোয়ারে। এরপর টানা তিন মৌসুম তিনি ছিলেন কাতালান ডাগ আউটে।

এরপরই পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। তিনি ছেড়ে দেন বার্সেলোনার দায়িত্ব। নিজের কোচিং ক্যারিয়ারটা আরেকটু সমৃদ্ধ করতেই তিনি নতুন এক চ্যালেঞ্জ কাঁধে তুলে নেন। স্পেন জাতীয় দলের দায়িত্ব পেয়ে যান ট্রেবেল শিরোপা জয়ী এনরিকে। প্রত্যাশার একটা চাপ তাঁর উপর এসে পড়ে ঠিক। ২০০৮-১২ এই সময়ে টানা তিন শিরোপা জেতা স্পেন যেন ২০১২ ইউরোর পর হারিয়ে যেতে বসেছিল। ‘স্প্যানিশ আর্মাডা’ পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

আর তাইতো শক্ত নাবিকের হাতে দেওয়া হয় দায়িত্ব। তবে মাঝে হুট করেই কোন রকম সাড়াশব্দ ছাড়াই তিনি চলে যান আড়ালে। একেবারে নিভৃতে। অদ্ভুত ঠাওর হলেও প্রশ্ন করারও কোন সুযোগ তিনি রেখে যাননি। চারটা মাস তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশ্য এর বেশি তিনি আর ফুটবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি। ফুটবলকে একবার ভালবেসে ফেললে তা থেকে দূরে থাকা তো যায় না।

২০১৯ এর সেপ্টেম্বর নাগাদ তিনি আবার যুক্ত হন স্পেন জাতীয় দলের সাথে। জানা যায় এনরিকের মেয়ে মারা যায় ‘বোন-ম্যারো ক্যান্সারে’। ছোট মেয়ের এমন অকাল প্রয়াণ তিনি মেনে নিতে পারেননি। সময় নিয়েছেন, নিজেকে বুঝিয়েছেন। এরপর আবার ফিরেছেন ফুটবলের সবুজ গালিচায়। সেখানটায় আবার তিনি ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন।

তাঁর ছক মত খেলেই ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের টিকিট কেটে ফেলেছে স্পেন। এনরিকের কাছে বেশ ভালমানের তরুণ খেলোয়াড়দের রসদও রয়েছে ভরপুর। তিনি সে রসদের ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারবেন কি না সেটা এখন প্রশ্নের বিষয়। দেখা যাক, শেষ অবধি আবার শিরোপা পুনঃরুদ্ধার করতে পারে কি না স্পেন, এনরিকের সাহায্যে।

তবে ডাগআউটে যখন লুইস এনরিকের মত একজন অভিজ্ঞ এবং চৌকস কোচ রয়েছেন তখন নিশ্চয়ই নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন স্প্যানিশরা। আরও একটি শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরবে স্প্যানিশ আর্মাডা সেটাই হয়ত প্রত্যাশা সকলের। দক্ষ নাবিক এনরিকে নিশ্চয়ই দেখাবেন পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link