ম্যারাডোনাও রক্ত মাংসের মানুষ

সামগ্রিক  ফুটবলেরই একটা অদ্বিতীয় চরিত্র ছিল এই ডিয়েগো ম্যারাডোনা। রোমানিয়ার কিংবদন্তি গিওর্গি হাজি তাই এভাবে বলেছেন, ‘তাঁর জন্য একটাই শব্দ- জিনিয়াস। বল নিয়ে যা করতেন তা ফুটবল না। শিল্প।’ এই শিল্পের সবচেয়ে বড় শিল্পী  ফুটবল ঈশ্বর খ্যাত জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনাও যে রক্ত মাংসের মানুষ ছিল সেটিই যেন জীবনের শেষ দিনে  প্রমাণ করে দিলেন।

বিশ্বকাপ, ফুটবল, কিংবদন্তি প্রথম এই তিনটি শব্দের পরের চতুর্থ শব্দটিই ডিয়েগো ম্যারাডোনা এই কথা অস্বীকার করবে এমন লোক খুব সম্ভবত নেই। এই কথার স্বপক্ষে কয়েকটি জোরালো যুক্তি দেখালে আপনি ‘সম্ভবত’ শব্দটিও এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেবেন। ৮৬’র মেক্সিকো বিশ্বকাপে তারকাবিহীন আর্জেন্টিনাকে একক ক্যারিশমায় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করান ম্যারাডোনা।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল, সেই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতার সিলভার বুট  ম্যারাডোনার ট্রফি ক্যাবিনেটে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার করা দ্বিতীয় গোলটি ফিফা শতাব্দী সেরা গোলের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৬ এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপের অলস্টার  দলের একজন ,  ১৯৮৬ ওয়ার্ল্ড সকারের বর্ষসেরা ফুটবলার, অত:পর ২০০০ সালে দর্শক ভোটে   ফিফার শতাব্দীসেরা ফুটবলার কিংবদন্তি হতে আর বাকি থাকল কি!

সর্বাকালের সেরার প্রশ্নে ম্যারাডোনার সাথে কেবল পেলের নাম উচ্চারিত হয় এই প্রসঙ্গে ফরাসি কিংবদন্তি এরিখ কাতোঁনা কি বলে শুনুন, ‘পেলের সঙ্গে ম্যারাডোনার বড় পার্থক্য, তাঁর চারপাশে গ্রেট ফুটবলাররা ছিলেন না। পুরো দলকে তাই টানতে হয় একাই। আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ দল থেকে ম্যারাডোনাকে সরিয়ে নিলে তারা বিশ্বকাপ জিততো না। কিন্তু আমি মনে করি, পেলেকে ছাড়াও ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিততো।’

১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যারাডোনাদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনাকে একসময় দখলের জন্য আক্রমণ করা ইংল্যান্ড। ম্যাচের তখন ৫১ মিনিট প্রতিপক্ষের একজন বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে উড়িয়ে মারেন নিজেদের গোলসীমায় অপ্রতিরোধ্য ম্যারাডোনা লাফিয়ে উঠে হেডের মতো করেন এবং একই সাথে চতুরতার সাথে বাঁ হাত দিয়ে বল পাঠিয়ে দেন জালে।

অন্ততকালের সেই মহাবিতর্কের ঠিক চার মিনিট পর নিজেদের অর্ধের  ডান প্রান্তের টাচ লাইন থেকে বল পায়ে নিয়ে ১১ সেকেন্ডে ১১ টাচে ৬৮ গজের সেই দৌড়  এবং ইতিহাস যে ইতিহাসকে পরবর্তীতে ফিফা শতাব্দী সেরা গোলের স্বীকৃতি দিয়েছেন।  এই গোল দুটি কেবল গোল না বরং তার চেয়েও বেশি কিছু।  তাতে একজন কিংবদন্তি ম্যারাডোনার জন্ম হয় যে ম্যারাডোনা পরবর্তীতে আর্জেন্টাইনদের ঈশ্বর হয়ে উঠেন।

ম্যারাডোনার সতীর্থ হোর্হে ভালদানো ম্যারাডোনাকে তুলনা করেন আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের সাথে, ‘ইংল্যান্ডকে হারানোর প্রতীকি মূল্য আমাদের কাছে অনেক। ওই এক ম্যাচ দিয়ে ম্যারাডোনা হয়ে গেলেন মহান দেশপ্রেমিক নেতার মত। তুলনীয় হন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়কদের সাথে।’ আর গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ফুটবল অনুরাগীদের আবেগের নাম ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার কথা বললে নাপোলির কথা উপেক্ষা করা যায় না। যে ক্লাব বেশিরভাগ সময় লড়াই করত রেলিগেশন এড়াতে।  ম্যারাডোনার সাত বছরে তাদের  ইটালিয়ান সিরি ‘এ’ জিতিয়েছেন দু’বার, উয়েফা সুপার কাপ একবার, ইতালিয়ান সুপার কাপ একবার এবং ইতালিয়ান কাপ একবার করে জিতিয়েছে।

এই ম্যারাডোনা ১৯৮৪ সালে যখন নাপোলির হয়ে সাইন করেছিলেন সেদিন তাকে বরন করে নিতে স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলেন ৭৫ হাজার দর্শক। বিনিময়ে নাপোলিতে সাত বছরের ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনাও কম তাঁদের কম দেন নি। এতটায় দিয়েছেন যে নাপোলির ইতাহাস থেকে যদি কোনোদিন সমস্ত কিছুও মুছে যায় তবুও ম্যারাডোনার নাম থেকে যাবে। নেপলসবাসীর হৃদয় মন্দিরে খোদায় করা আছে সেই নাম মুছে ফেলার সাধ্য কার।

এই আর্জেন্টাইন যাদুকরের জন্ম বুয়েনস আইরেসের এভিতা হাসপাতালে ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর। বাবা ডন ডিয়েগো ছিলেন কারখানার মজুর। অভাব অনটনের সংসারে লাতিন আমেরিকার আর আট-দশটা ফুটবলারের গল্পের মতোই ম্যারাডোনার উঠে আসার গল্প।

পরবর্তীতে শৈশব নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যারাডোনা বলেন, আমার মা প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যেতেন  যেন আমরা খেতে পারি।  কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও বাবা আমাকে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন। এমন একটা সময় ছিল যখন আমার অনুশীলনে যাওয়ার বাস ভাড়াও জোগাড় করতে হয় অন্যের কাছ থেকে ধার করে।’

সামগ্রিক  ফুটবলেরই একটা অদ্বিতীয় চরিত্র ছিল এই ডিয়েগো ম্যারাডোনা। রোমানিয়ার কিংবদন্তি গিওর্গি হাজি তাই এভাবে বলেছেন, ‘তাঁর জন্য একটাই শব্দ- জিনিয়াস। বল নিয়ে যা করতেন তা ফুটবল না। শিল্প।’ এই শিল্পের সবচেয়ে বড় শিল্পী  ফুটবল ঈশ্বর খ্যাত জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনাও যে রক্ত মাংসের মানুষ ছিল সেটিই যেন জীবনের শেষ দিনে  প্রমাণ করে দিলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...