১৯৯২ বিশ্বকাপ, পিঞ্চ হিটার এবং…

৪১ টা টেস্টে মোটে ২০২১ রান, ব্যাটিং গড় সর্ব সাকুল্যে ৩০.৬২। তিনটি সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৪৬ রানের ইনিংস। ওয়ানডের রেকর্ডও তথৈবচ, ৮৪ টি ম্যাচে ২২০৬ রান, গড় সাকুল্যে ২৮.২৮, তিনটি শতক (সর্বোচ্চ ১১১) আর তেরোটা হাফ সেঞ্চুরি।

এমন পরিসংখ্যান দেখলে মনে হবে নেহায়েতই পাতে দেবার মতো নয়। মনে রাখার মতোও কিছু নয়। তাও মনে রয়ে গেছেন, আমার। তিনি হলেন নিউজিল্যান্ডের মার্ক গ্রেটব্যাচ।

এখনকার ঝড়ো ক্রিকেট দেখলে, দু’জনের কথা খুব মনে পড়ে। একজন কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, আরেকজন এই গ্রেটব্যাচ। কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত প্রথম বল থেকেই আক্রমণাত্মক খেলতেন, ‘মেরে খেলে’ বোলারের আত্মবিশ্বাসটাই নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। তবু, খেলার চরিত্রকে বদল করতে পারেননি। কিন্তু, আমার মনে হয়, এই একজন খেলোয়াড় একদিনের ক্রিকেটের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন।

১৯৯২ সাল। বিশ্বকাপের আসর বসেছে, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে। রংচঙে পোশাক, সাদা বল, দিন-রাতের ম্যাচ, কালো সাইটস্ক্রিন – সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ, আগে কখনো বিশ্বকাপে হয়নি। শচীন টেন্ডুলকার আছেন, ব্রায়ান লারা আছেন, আছে মার্টিন ক্রো, ইয়ান বোথাম, ইমরান খান – কতো বর্ণময় চরিত্র। আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সদ্য ফিরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকা, আছে ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু একজন গ্রেটব্যাচ একদিনের ক্রিকেটের খেলার গতিপথটাই বদলে দিয়েছিলেন।

টুর্নামেন্ট শুরু হবার পর দেখা গেলো, একটি দল এগিয়ে চলেছে তরতরিয়ে। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো। ডার্ক হর্স। নিউজিল্যান্ড। একের পর এক ম্যাচ জিতে চলেছে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া, তারপর শ্রীলঙ্কা। কোন ম্যাচেই খেলেননি গ্রেটব্যাচ। সুযোগ পাননি। সুযোগ এলো, তৃতীয় ম্যাচে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। ৬০ বলে ৬৮ রান (৪×৯, ৬×২)। সঙ্গে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও বাগিয়ে নিলেন। পরের ম্যাচ জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে। ১৬ বলে ১৫ রান (৪×২)। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ৭৭ বলে ৬৩ রান (৪×৭, ৬×৩)। ভারতের বিপক্ষে করলেন ৭৭ বলে ৭৩ রান (৪×৫, ৬×৪)। এবারও ম্যাচ সেরা।

ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৭ বলে ৩৫ রান (৪×৪, ৬×১)। রাউন্ড-রবিন লিগের শেষ ম্যাচ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তা সেখানে, ৪২ রান করলেন ৬৭ বলে (৪×৫, ৬×১)। একদম শেষে, অশ্বমেধের ঘোড়া যেখানে মুখ থুঁবড়ে পড়লো, সেমি-ফাইনালে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২২ বলে ১৭ রান (৬×২)।

খুব আশাপ্রদ মনে হলো না বোধহয়, না? আসলে, সনাথ জয়সুরিয়া, বীরেন্দ্র শেবাগ কিংবা একালের এবি ডি ভিলিয়ার্স অথবা বিরাট কোহলিদের খেলা দেখে এই স্কোর বা এই স্টাইক রেট দারুণ কিছু মনে লাগার মতো নয়। কিন্তু, ১৯৯২ সালে, যখন ৭০-৭২ বলে ৫০ রান অথবা ১২০-১৩০ বলে সেঞ্চুরি করাটা খুব স্বাভাবিক ছিল।

যখন প্রথম পনেরো ওভারে ২৫ থেকে ৩০ রান হলেই অনেক ছিল। যখন, ২২৫ থেকে ২৫০ রান মানেই ম্যাচ ‘প্রায় পকেটে’। তখন, গ্রেটব্যাচই প্রথম পিঞ্চ হিটার ওপেনার ছিলেন। প্রথম পনেরো ওভারেই দলের রান ষাট, সত্তর অথবা আশি করে দেওয়া, সেই প্রথম দেখা।

হ্যাঁ, তিনি মার্ক গ্রেটব্যাচ। প্রথম পনেরো ওভারের ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশনের (৩০ গজ বৃত্তের বাইরে দুজন ফিল্ডার থাকবে) সম্পূর্ণ সুবিধাটা যিনি নিতে শিখিয়েছিলেন সারা বিশ্বকে। পিঞ্চ-হিটারের সংজ্ঞাটা যিনি প্রথম স্থির করে দিয়েছিলেন। এরপরে, ১৯৯৬ সালে, জয়সুরিয়া-কালুভিতারানা এই দেখানো পথে তাণ্ডবলীলা করেছেন। কিন্তু প্রথম?

আহ্হা, আরে না না। ভিভ রিচার্ডসকে ভুলিনি। দিব্বি মনে আছে। চুইংগাম চিবোতে চিবোতে বলের সাথে বোলারের ছাল-চামড়া যে গুটিয়ে দিতেন, বেশ জানি। বেশ কয়েকবার দেখেওছি। কিন্তু প্রথমবল থেকে বোলারকে আক্রমণ করে, খেলাটা বের করে নিতে আর কাউকে দেখিনি। শ্রীকান্তকে মনে রেখেই বলছি। ১৯৯২ সালে, মার্ক গ্রেটব্যাচ শিখিয়ে গেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link